ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বাড়ছে আন্তর্জাতিক চাপ, বন্ধ হবে কি গাজা যুদ্ধ?

গাজার বিরুদ্ধে ইসরায়েলের চলমান যুদ্ধের জন্য আন্তর্জাতিক জনমত ক্রমশ ইসরায়েলের বিপক্ষে যাচ্ছে। এর ফলে আরও বেশ কয়েকটি দেশের সরকার ধীরে ধীরে এই জনমতকে প্রতিফলিত করতে শুরু করেছে এবং ইসরায়েলের বিরুদ্ধে তাদের নিন্দা জানাচ্ছে। গত কয়েক সপ্তাহে বেশ কয়েকটি পশ্চিমা দেশ ইসরায়েল সরকারের মন্ত্রীদের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও কানাডা গাজায় ‘অসহনীয়’ মাত্রার ‘মানবিক দুর্ভোগের’ নিন্দা জানিয়ে একটি যৌথ বিবৃতি দিয়েছে।
এই সপ্তাহের শুরুতে গ্লোবাল সাউথভুক্ত দেশগুলোর একটি জোট ‘দ্য হেগ গ্রুপ’ সম্মিলিতভাবে বেশ কয়েকটি পদক্ষেপে একমত হয়েছে। তারা বলেছে, ‘অধিকৃত ফিলিস্তিনি অঞ্চলগুলোতে ইসরায়েলের আক্রমণকে নিয়ন্ত্রণ করবে।’ গাজার একটি ক্যাথলিক গির্জায় ইসরায়েলি হামলার পর বিশ্বজুড়ে ক্রমবর্ধমান সংখ্যক সাধারণ মানুষ, রাজনীতিবিদ ধর্মীয় নেতারা গাজায় ইসরায়েলের হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে মুখ খুলছেন।
প্রশ্ন উঠেছে, বিশ্ব শক্তিগুলো কি অবশেষে ইসরায়েলের ওপর যথেষ্ট চাপ প্রয়োগের কাছাকাছি পৌঁছেছে, যাতে এটি বন্ধ করা যায়?
হেগ গ্রুপ কী ও তারা কী পদক্ষেপ নিলো?
হেগ গ্রুপের ওয়েবসাইট অনুসারে এটি আন্তর্জাতিক আইন রক্ষা ও ফিলিস্তিনের জনগণের সঙ্গে সংহতি প্রকাশের জন্য ‘সমন্বিত আইনি ও কূটনৈতিক পদক্ষেপ’ গ্রহণের প্রতিশ্রুতিবদ্ধ রাষ্ট্রগুলোর একটি বিশ্বব্যাপী জোট।
দক্ষিণ আফ্রিকা, বলিভিয়া, কলম্বিয়া, কিউবা, হন্ডুরাস, মালয়েশিয়া, নামিবিয়া ও সেনেগাল– এই আটটি দেশের সমন্বয়ে গঠিত এই গ্রুপটি আন্তর্জাতিক আইন সমুন্নত রাখা ও জাতিসংঘের সনদে বর্ণিত নীতিগুলো রক্ষা করার লক্ষ্যে কাজ করে। মূলত ‘সব জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারসহ অবিচ্ছেদ্য অধিকারগুলো সমুন্নত রাখার দায়িত্ব’ তাদের প্রধান লক্ষ্য।
এই সপ্তাহের শুরুতে হেগ গ্রুপ কলম্বিয়ার রাজধানী বোগোটায় চীন, স্পেন ও কাতারসহ প্রায় ৩০টি দেশের একটি সভার আয়োজন করে। সভায় জাতিসংঘের বিশেষ দূত ফ্রান্সেসকা আলবানিজও উপস্থিত ছিলেন। যিনি এই সভাকে গত ২০ মাসের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক উন্নয়ন হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। উল্লেখ্য, সম্প্রতি আলবানিজকে তার মিত্র ইসরায়েলের সমালোচনা করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল।
হেগ গ্রুপ দুই দিনের বৈঠক শেষে উপস্থিত ১২টি দেশ গাজায় ইসরায়েলের কর্মকাণ্ড সীমিত করার জন্য ছয়টি পদক্ষেপে সম্মত হয়েছে। এই পদক্ষেপগুলোর মধ্যে রয়েছে— ইসরায়েলে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করা, অস্ত্র পরিবহণের জাহাজের ওপর নিষেধাজ্ঞা ও ফিলিস্তিনের দখলদারিত্ব থেকে উপকৃত কোম্পানিগুলোর সঙ্গে সম্ভাব্য সংযোগের জন্য সরকারি চুক্তি পর্যালোচনা করা।
অন্যান্য কোন সরকার কী পদক্ষেপ নিয়েছে?
স্লোভেনিয়া গত বুধবার (১৬ জুলাই) তার ভূখণ্ডে জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইটামার বেন-গভির ও অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচকে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। যখন ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ মোকাবিলায় ব্যবস্থা গ্রহণে একমত হতে ব্যর্থ হয়েছে, তখনই স্লোভেনিয়া এই পদক্ষেপ নেয়।
স্লোভেনিয়া যে দুই ইসরায়েলি মন্ত্রীর ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, তা আসলে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ড, যুক্তরাজ্য ও নরওয়ের আগের নিষেধাজ্ঞার সূত্র ধরে। গত জুন মাসে ওই দেশগুলো স্মোট্রিচ ও বেন-গভিরের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল সহিংসতা উসকে দেওয়ার অভিযোগে। এই দুই মন্ত্রী ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে কোনো ধরনের সমঝোতা করতে রাজি নন। বরং, তারা গাজায় ইহুদি বসতি স্থাপন ও দখল করা পশ্চিম তীরে অবৈধ বসতি বাড়ানোর জন্য সবচেয়ে বেশি সরব ছিলেন।
মে মাসে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও কানাডা একটি যৌথ বিবৃতি দিয়ে গাজার বিরুদ্ধে ইসরায়েলের অভিযানকে সম্পূর্ণ অসঙ্গতিপূর্ণ বলে বর্ণনা করে। ইসরায়েল যদি তাদের আক্রমণ বন্ধ না করে তবে তাদের বিরুদ্ধে জোরালো পদক্ষেপ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়।
মে মাসের শেষের দিকে যুক্তরাজ্য কিছু বসতি স্থাপনকারী সংস্থার ওপর নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করে ইসরায়েলের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য আলোচনা ‘বিরতি’ ঘোষণা করে। এ ছাড়াও মে মাসে তুর্কমেনিস্তান ঘোষণা করে, গাজার মানবিক পরিস্থিতির সমাধান না হওয়া পর্যন্ত তারা ইসরায়েলের সঙ্গে সমস্ত বাণিজ্য বন্ধ করে দেবে।
দক্ষিণ আফ্রিকা প্রথম ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের শেষের দিকে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার জন্য একটি মামলা দায়ের করে। তখন থেকে কলম্বিয়া, চিলি, স্পেন, আয়ারল্যান্ড ও তুর্কমেনিস্তানসহ অন্যান্য দেশগুলো এটিকে সমর্থন করেছে।
২০২৪ সালের জানুয়ারিতে আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) একটি প্রাথমিক রায় দেয়। তারা জানায়, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ ‘যুক্তিযুক্ত’ বলে মনে হচ্ছে। আদালত ইসরায়েলকে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দেয়। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়, মার্চ মাস থেকে ইসরায়েল সরকার ফিলিস্তিনিদের যে সহায়তা বন্ধ করে দিয়েছিল, তা যেন আবার চালু করা হয়।
ইসরায়েলের আর কোনো সমালোচনা হয়েছে?
গাজা শহরের হলি ফ্যামিলি গির্জায় বৃহস্পতিবার ইসরায়েলের বোমা হামলায় তিনজন নিহতের ঘটনায় ইসরায়েলের সবচেয়ে শক্তিশালী মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিন্দা জানিয়েছে। বোমা হামলার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ‘ক্ষুব্ধ’ ফোন কলের পর ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কার্যালয় এই হামলার জন্য ‘গভীর দুঃখ’ প্রকাশ করে একটি বিবৃতি দিয়েছে। এখন পর্যন্ত ইসরায়েল গাজায় ৫৮ হাজারেও বেশি মানুষকে হত্যা করেছে, যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু।
আন্তর্জাতিকভাবে কি পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটেছে?
গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধের বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে ব্যাপক জনসাধারণের বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে। যুদ্ধের বর্বরতা ও গাজায় ফিলিস্তিনিদের ওপর এর প্রভাবে যে ক্ষোভ দেখা যাচ্ছে, তার স্পষ্ট লক্ষণ রয়েছে।
জুন মাসে পশ্চিম ইউরোপে পোলিং সংস্থা ইউগোব দ্বারা পরিচালিত একটি জরিপে দেখা গেছে, ট্র্যাকিং শুরু হওয়ার পর থেকে ইসরায়েলের প্রতি আনুকূল্য সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে। এই সপ্তাহে সিএনএন দ্বারা পরিচালিত একই ধরনের জরিপে আমেরিকান জনসাধারণের মধ্যে একই রকম ফলাফল পাওয়া গেছে। মাত্র ২৩ শতাংশ উত্তরদাতা গাজায় ইসরায়েলের পদক্ষেপকে সম্পূর্ণরূপে ন্যায্য বলে একমত হয়েছেন, যা ২০২৩ সালের অক্টোবরে ৫০ শতাংশ ছিল।
জার্মানির ফিউশন ফেস্টিভ্যাল, পোল্যান্ডের ওপেন’য়ার ফেস্টিভ্যাল ও যুক্তরাজ্যের গ্লাস্টনবারি ফেস্টিভ্যাল-এর মতো উচ্চ-প্রোফাইল পাবলিক ইভেন্টগুলোতেও জনসাধারণের ক্ষোভ প্রকাশ পেয়েছে। যেখানে শিল্পী ও তাদের সমর্থকরা উভয়ই গাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধের নিন্দা করার জন্য তাদের প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করেছেন।
ইসরায়েলে কি কিছু পরিবর্তন হয়েছে?
যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এখনও ছোট হলেও ক্রমেই বাড়ছে। স্ট্যান্ডিং টুগেদার-এর মতো সংগঠনগুলো যুদ্ধের প্রতিবাদে ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনি কর্মীদের একত্রিত করেছে।
এ ছাড়াও, ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীতে ক্রমবর্ধমান সংখ্যক রিজার্ভ সৈন্য দায়িত্ব পালন করতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে। গত এপ্রিল মাসে ইসরায়েলি ম্যাগাজিন +৯৭২ এর এক প্রতিবেদনে জানায়, এ লাখেরও বেশি রিজার্ভ সৈন্য ডিউটিতে আসতে রাজি হয়নি। সামরিক বাহিনীর ভেতর থেকেও যুদ্ধের প্রতিবাদে খোলা চিঠি লেখা হচ্ছে, এর পর থেকে প্রতিবাদকারীদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
এতে কি কোনো চাপ আসবে?
নেতানিয়াহুর কট্টর-ডানপন্থী সরকার গাজায় যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে, যদিও দেশের ভেতরে ও বাইরে তাদের জনপ্রিয়তা কমছে। সম্প্রতি সরকার প্রস্তাব করেছে, গাজার সব মানুষকে ‘মানবিক শহর’ নামে এক জায়গায় আটকে রাখা হবে। সমালোচকরা এটাকে ‘গণহত্যা শিবিরের’ সঙ্গে তুলনা করছেন। তাদের মতে, এটা প্রমাণ করে যে ইসরায়েল আন্তর্জাতিক আইন বা বিশ্বের মতামতকে আর কোনো গুরুত্ব দিচ্ছে না।
আন্তর্জাতিকভাবে গাজার একটি ক্যাথলিক গির্জায় বোমা হামলার জন্য ইসরায়েল সমালোচিত হলেও তাদের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন এখনো অটুট। ইসরায়েলের অনেকেই মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের এই অবিরাম সমর্থন, বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থন তাদের একমাত্র কূটনৈতিক শক্তি। গাজায় তাদের কার্যক্রমের জন্য যেকোনো আন্তর্জাতিক চাপ মোকাবিলায় তারা এই সমর্থনের ওপরই ভরসা করে।

জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে মার্কিন ভেটো ব্যবহারের মাধ্যমে কূটনৈতিক গ্যারান্টি ও তার বিস্তৃত অস্ত্রাগারের মাধ্যমে সামরিক সহায়তার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) মতো ইসরায়েলের সমালোচকদের বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ব্যবহারও দেখা গেছে। আইসিসির সদস্যদের জুন মাসে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে নেতানিয়াহু ও সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করার পর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল।
এর অর্থ, স্বল্পমেয়াদে যতক্ষণ পর্যন্ত মার্কিন সমর্থন থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত ইসরায়েল শেষ পর্যন্ত সুরক্ষিত বোধ করবে। কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে এটি যত বেশি বিচ্ছিন্ন হয়ে উঠবে অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতা মোকাবিলা করা আরও কঠিন হয়ে উঠবে।