যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনায় আরও ছাড় আদায়ের চেষ্টায় চীন

তিন মাসে তৃতীয়বারের মতো ইউরোপে মুখোমুখি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের ঊর্ধ্বতন বাণিজ্য কর্মকর্তারা। তবে এবারের স্টকহোম বৈঠকে আগের চেয়ে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাস নিয়ে অংশ নিচ্ছে বেইজিং।
চীনের কৌশলগত খনিজ সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ যুক্তরাষ্ট্রকে কিছু নিষেধাজ্ঞা শিথিল করতে বাধ্য করেছে, যার মধ্যে রয়েছে এনভিডিয়ার গুরুত্বপূর্ণ এআই চিপ রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া, যা একপ্রকার নাটকীয় নীতির পরিবর্তন। খবর সিএনএনের।
এদিকে, মার্কিন নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও চীনের অর্থনীতি প্রত্যাশার চেয়েও ভালো উন্নতি করছে। সরকারি তথ্যে দেখা গেছে, রেকর্ড পরিমাণ বাণিজ্য উদ্বৃত্ত অর্জন করেছে চীন, যা তাদের রফতানি খাতের দৃঢ়তা ও যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরতা কমানোর কৌশলের ইঙ্গিত দেয়।
সম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে একটি সম্মেলনেও চীন তাদের কঠোর অবস্থান বজায় রেখেছে, যেখানে বাণিজ্য ভারসাম্য ও ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে ইউরোপের উদ্বেগের বিষয়ে খুব কম প্রতিশ্রুতি দেয় বেইজিং।
স্টকহোমে সোমবার (২৮ জুলাই) শুরু হতে যাওয়া নতুন আলোচনা পর্বে চীনের উপপ্রধানমন্ত্রী হে লিফেং নেতৃত্ব দিচ্ছেন এবং ধারণা করা হচ্ছে, তারা এবার আরও দৃঢ় ও অনমনীয় অবস্থান নিয়ে আলোচনায় আসছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে নতুন ছাড় আদায়ের চেষ্টায় থাকবে।
মার্কিন প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বে থাকা ট্রেজারি সেক্রেটারি স্কট বেসেন্ট বলেন, তারা আলোচনা করবেন চলমান বাণিজ্য বিরতির (যার মেয়াদ ১২ আগস্ট শেষ হচ্ছে) সম্ভাব্য প্রসারণ নিয়ে।
এই বিরতি (ট্রুস) প্রথমে মে মাসে জেনেভায় একটি বৈঠকে শুরু হয়, যা তিন অঙ্কের শুল্ক আরোপ থেকে সাময়িক বিরত রাখে — এসব শুল্ক দুই অর্থনৈতিক পরাশক্তির মধ্যে বাণিজ্য বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিল।
এরপর জুনে লন্ডনের আলোচনায় সেই চুক্তি টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয়, যখন উভয় পক্ষ একে অপরের প্রতিশ্রুতি না রাখার অভিযোগ তোলে। এখন স্টকহোমের আলোচনায় নজর থাকবে এই বিরতি কতটা দীর্ঘস্থায়ী হবে এবং প্রযুক্তি নিষেধাজ্ঞার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর সমাধানে কতটা অগ্রগতি হয়।
চীন এই বৈঠকে তাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক তুলে নেওয়ার ওপর গুরুত্ব দেবে। বর্তমানে প্রায় ৫৫ শতাংশ শুল্ক চীনা পণ্যের ওপর বলবৎ রয়েছে — যার মধ্যে রয়েছে: ১০ শতাংশ প্রতিশোধমূলক শুল্ক, ২০ শতাংশ শুল্ক ফেন্টানিল পাচারে চীনের ভূমিকার জন্য এবং পূর্ববর্তী নানা ধরনের শুল্ক।
চীনের জন্য ফেন্টানিল-সংশ্লিষ্ট শুল্ক তুলে নেওয়া একটি প্রধান অগ্রাধিকার। গত মাসে চীন দুটি নতুন ফেন্টানিল উপাদানকে নিয়ন্ত্রিত মাদকের তালিকায় যুক্ত করেছে এবং নাইটাজিনস (এক ধরনের সিনথেটিক ওপিওয়েড)-কেও নিষিদ্ধ তালিকায় এনেছে।
চীনা থিঙ্ক ট্যাংক 'সেন্টার ফর চায়না অ্যান্ড গ্লোবালাইজেশন'-এর সিনিয়র ফেলো হে ওয়েইওয়েন বলেন, এই আলোচনায় প্রথম লক্ষ্য হবে পুরনো আলোচনার ভিত্তিতে অগ্রগতি সাধন এবং দৃশ্যমান ফলাফল আদায় করা।
অন্যদিকে, চীনের পক্ষ থেকে মার্কিন প্রযুক্তি রফতানির নিষেধাজ্ঞা শিথিলের দাবিও আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বাণিজ্য বিভাগের "এনটিটি লিস্ট"-এ থাকা শত শত চীনা কোম্পানির ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়ের আমেরিকান স্টাডিজ সেন্টারের পরিচালক উ শিনবো বলেন, “এখন যুক্তরাষ্ট্র বুঝতে পারছে যে চীনের হাতে গুরুত্বপূর্ণ কার্ড রয়েছে — এবং এখন চীন এসব কার্ড খেলতে প্রস্তুত।”
তিনি উল্লেখ করেন, শুধু বিরল খনিজ পদার্থ নয়, ড্রোন ও বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারি নির্মাণেও চীন বিশ্বব্যাপী অপরিহার্য ভূমিকা রাখছে।
এপ্রিলের উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে চীন রেয়ার আর্থ রফতানির জন্য নতুন লাইসেন্সিং চালু করে এবং কিছু খনিজ উপাদানের রফতানি কমিয়ে দেয়। এর প্রতিক্রিয়ায় ট্রাম্প প্রশাসন চিপ সফটওয়্যার, ইথেন ও জেট ইঞ্জিনের রফতানি নিয়ন্ত্রণে আনে। শেষমেশ লন্ডন বৈঠকে সমঝোতা হয় — চীন রেয়ার আর্থ রফতানি চালু করে, আর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়।

রাশিয়া ও ইরান থেকে চীনের তেল আমদানির বিষয়টি আলোচনায় থাকবে। বেসেন্ট জানিয়েছেন, এ নিয়ে চীনকে সতর্ক করবেন তিনি।
টিকটক-এর মার্কিন শাখা বিভাজন (স্পিনঅফ) বিষয়ে আলোচনা হবে, যা এখনো বেইজিংয়ের অনুমোদনের অপেক্ষায়।
যুক্তরাষ্ট্রে আটকানো মার্কিন কর্মকর্তাদের বিষয়েও আলোচনা হবে। চীনে এক মার্কিন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মী এবং ওয়েলস ফার্গোর এক কর্মকর্তাকে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র নিন্দা জানিয়েছে।