মোবাইল ফোনে আমরা কী দেখি, কোথায় হারিয়ে যাই?

ইন্টারনেট সংযোগ দিয়ে ফেসবকু, ইউটিউবসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করা যায় এমন মোবাইল ফোন (অ্যান্ড্রয়েড) ব্যবহারকারীদের উল্লেখযোগ্য একটা অংশের মধ্যে আসক্তি বিদ্যমান। এই আসক্তি হচ্ছে- ফেসবুক বা ইউটিউবে অশ্লীল ভিডিও বা কনটেন্ট দেখার আসক্তি। ঢাকার অধিকাংশ বাসাবাড়িতে এখন ইন্টারনেট সংযোগ রয়েছে। আনলিমিটেড ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ কাজে লাগিয়ে শিশু থেকে শুরু করে বয়স্ক মানুষরাও এমন আসক্তিতে পরেছে। সময় পেলেই মোবাইল হাতে নিচ্ছেন কর্মজীবীরাও, অশ্লীল কিছু নেখতে না চাইলেও কনটেন্ট বুস্ট করার কারণে চোখের সামনে দোলা দেয় এসব কনটেন্ট। ফলে একনজর দেখতে গিয়ে কখন যে ঘণ্টা পার হয়ে যাচ্ছে তা টেরও পাচ্ছেন না ব্যবহারকারীরা।
অথচ মোবাইল ফোনের প্রতি আসক্তি বর্তমানে একটি গুরুতর সমস্যা যা সময় এবং স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে, মানুষ প্রতিদিন গড়ে ৫ ঘণ্টার বেশি সময় স্মার্টফোনে ব্যয় করে। রাতে ফোন ব্যবহারের কারণে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে, যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। অতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহার মানসিক চাপ, উদ্বেগ ও বিষণ্নতার কারণ হতে পারে। চোখের সমস্যা, ঘাড় ও কোমরের ব্যথা এবং শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। মোবাইল ফোনের প্রতি আসক্তি সামাজিক সম্পর্ক থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারে, কারণ মানুষ বাস্তব জগতের চেয়ে ভার্চুয়াল জগতে বেশি সময় কাটায়।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ হচ্ছে, মোবাইল ব্যবহারের ক্ষেত্রে সময়সীমা নির্ধারণ করা এবং অন্যান্য কাজে মনোযোগ দেওয়া। এছাড়া শারীরিক কসরত, সামাজিকীকরণ ও পর্যাপ্ত ঘুমের মাধ্যমে মোবাইল আসক্তি কমানো যেতে পারে। কিন্তু মানুষের আসক্তি এমন পর্যায়ের পৌঁছেছে যে, মানুষ রাতভর মোবাইল ফোন দেখেন আর সকালে ঘুমাতে যান। অনেকে ঘুম থেকে ওঠে বাথরুমে মোবাইল নিয়ে যান, সেখানে দীর্ঘ সময় কাটিয়ে দেন।
একটা শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার ছয় মাসের মধ্যেই এই মোবাইল ফোনে আসক্ত হয়ে পড়ছে অথবা আমরা আসক্ত করে ফেলছি। শিশু যখন কান্না করে তখন তার কান্না থামানোর একমাত্র মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে মোবাইল ফোন। কার্টুন দেখিয়ে তার কান্না থামাতে হচ্ছে। শিশুদের সাধারণত খাওয়ার ব্যাপারে অনাগ্রহ থাকে। এখন অধিকাংশ বাবা-মা তাদের খাওয়ানোর ব্যাপারে মোবাইলের বিভিন্ন অ্যাপস ব্যবহার করে তাদের খাওয়ানোর চেষ্টা করেন বা খাওয়ান। কিন্তু এর সুদূরপ্রসারী ক্ষতিকর দিক আছে। অনেক বাবা-মা আহ্লাদ করে ছেলেমেয়ের হাতে মোবাইল তুলে দিয়ে তাকে স্মার্ট বানানোর কথাও বিভিন্ন জায়গায় প্রকাশ করেন। কিন্তু দিন শেষে বাচ্চাদের সর্বনাশ ডেকে আনছেন। যখন এটি বুঝতে পরছেন ততক্ষণে কিন্তু সবই শেষ। আর শত চেষ্টা করেও তাকে ফেরানো যায় না। এখন মাদকাসক্তের চেয়েও বড় নেশা হলো স্মার্টফোন। এ নেশা থেকে ছেলেমেয়েদের বের করে আনা প্রায় দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। বেশি চাপ দিলে অথবা সাময়িক মোবাইল ফোনটি নিয়ে নেওয়া হলে বড় ধরনের বিপত্তিও ঘটছে। কখনো কখনো খাবার খাওয়া বন্ধ করে দেয়। একাকী এক রুমে বসে বিষণ্নতায় ভোগে। এক সময় সবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বড় ধরনের অঘটন ঘটিয়ে বসে। এমনকি আত্মহত্যার মতো ঘটনাও প্রায়ই আমরা ঘটতে দেখছি।
মোবাইল ফোনের কারণে অনেক সংসার ভেঙে তছনছ হয়ে যাচ্ছে। প্রতারণার শিকার হয়ে অনেক নারী সমাজে মুখ দেখাতে না পেরে সমাজ-বিচ্ছিন্ন শুধু নয়, শেষ পর্যন্ত নিজের জীবনও বিপন্ন করে ফেলছেন। সাম্প্রতিককালে মোবাইলে জুয়া খেলার প্রবণতা ব্যাপক বেড়েছে। এতে অনেকে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছেন।
যুবসমাজ যেভাবে মোবাইলে আসক্ত ও অসুস্থ হয়ে পড়ছে, তাতে মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় এখনই তাদের জন্য ব্যাপক উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। হাসপাতালগুলোতে ফ্রি কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির জন্য গ্রামগঞ্জের সর্বত্র জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করতে হবে। গ্রামগঞ্জের আনাচে-কানাচে এখন ইন্টারনেট খুবই সহজে পাওয়া যায়। ওয়াইফাই প্রতিটি পরিবারে পৌঁছে গেছে। এতে অতি সহজে ছেলেমেয়েরা এর ব্যবহার করতে পারছে। অনেক বাবা-মা ছেলেমেয়েদের ইন্টারনেটে ক্লাস করার বা ভালো কিছু জানার জন্য এই সুবিধা দিয়ে থাকেন। কিন্তু তারা যে এর চরম অপব্যবহার করছে, তা ঘুণাক্ষরেও পরিবারের সদস্যরা টের পান না। এক সময় এসব শিক্ষার্থীরা হারিয়ে যায় অন্ধকারে।
লেখক: হাসান আল বান্না, সাংবাদিক ও কলামিস্ট