প্রবাসী বিনিয়োগে দেশের বিভিন্নখাতে অগ্রগতি

বাংলাদেশি প্রবাসীরা এখন আর শুধু রেমিট্যান্স পাঠিয়েই সীমাবদ্ধ নন—তারা হয়ে উঠেছেন দেশের অর্থনীতির রূপান্তর ঘটানোর এক গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসরত প্রায় ১ কোটির বেশি প্রবাসী বাংলাদেশি কেবল অর্থই নয়, তাদের বিনিয়োগ ও উদ্যোগের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং অর্থনীতিকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করছেন, যা বাংলাদেশের উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা রাখছে।
প্রথাগতভাবে প্রবাসীদের অর্থনৈতিক অবদান বলতে বোঝায় রেমিট্যান্স, যা এখনো দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম দশ মাসেই বাংলাদেশ পেয়েছে রেকর্ড ২৪.৩৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। তবে এখন প্রবাসীরা সেই সীমা ছাড়িয়ে, সরাসরি উৎপাদন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বিনিয়োগ করছেন।
২০২৪ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত ‘এনআরবি কনক্লেভ’-এ “নলেজ রেমিট্যান্স” ধারণাটি বিশেষভাবে গুরুত্ব পায়। এতে তুলে ধরা হয় যে, প্রবাসীদের অবদান শুধুমাত্র অর্থনৈতিক নয়; বরং তাদের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক দেশের জন্য অপার সম্ভাবনা তৈরি করছে।
বর্তমানে প্রযুক্তি খাত সবচেয়ে বেশি প্রবাসী বিনিয়োগ আকর্ষণ করছে। ২০২৪ সালে এ খাতে মোট ৫৫ বিলিয়ন টাকা বিনিয়োগ হয়েছে, যার বড় অংশ এসেছে প্রবাসীদের পক্ষ থেকে। রিয়েল এস্টেট খাতও প্রবাসীদের জন্য বরাবরের মতো আকর্ষণীয়। ব্যক্তিগত আবাসন এবং ভাড়ার উদ্দেশ্যে বিনিয়োগের পাশাপাশি ধীরে ধীরে এই বিনিয়োগ এখন গড়াচ্ছে বাণিজ্যিক ও উৎপাদনমুখী খাতে। ২০২৫ সালে বাংলাদেশের রিয়েল এস্টেট মার্কেটের মূল্য ধরা হচ্ছে ২.৮৪ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার, যার বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ১.৯৯% হারে বাড়বে ২০২৯ সাল পর্যন্ত। অবকাঠামো খাতেও প্রবাসী বিনিয়োগের প্রভাব দৃশ্যমান। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে শুধু এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোনে বিনিয়োগ হয়েছে ৩৫০.৯৩ মিলিয়ন ডলার, যা কর্মসংস্থান ও রপ্তানিমুখী শিল্প বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।
সরকার এনআরবি বিনিয়োগকে উৎসাহিত করতে নীতিগতভাবে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ওয়েজ আর্নার বন্ডে বিনিয়োগের সীমা তুলে নেওয়া হয়েছে এবং এখন প্রবাসীরা অনির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ সরকারী বন্ডে বিনিয়োগ করতে পারবেন, যার মেয়াদ সর্বোচ্চ ১৫ বছর পর্যন্ত পুনঃবিনিয়োগযোগ্য।
এছাড়া এনআরবি বিনিয়োগকে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের সমতুল্য হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে এবং আইপিওতে ১০% কোটা বরাদ্দসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। এনআরবি ব্যাংকগুলো ২৫% প্রাইমারি শেয়ারে কোটা পাচ্ছে, যা পুঁজিবাজারে প্রবাসীদের সম্পৃক্ততা বাড়াচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, সঠিক নীতিগত সংস্কার হলে প্রতি বছর নির্মাণ খাতে ২৩.৭ লাখ, উৎপাদনে ৬.৬ লাখ, আর ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসে ৯৬,০০০ থেকে ৪.৬ লাখ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতে পারে। যদিও এই সব চাকরির উৎস একমাত্র প্রবাসী বিনিয়োগ নয়, তবে এই বিনিয়োগগুলোর মাধ্যমে এসব খাতকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে।
ব্যাংকিং খাতও এর সুফল পাচ্ছে। ২০২৪ সালে এই খাতে এসেছে ৪১৬.৩১ মিলিয়ন ডলার এফডিআই, যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এসেছে প্রবাসী-কেন্দ্রিক ব্যাংক থেকে। উদাহরণস্বরূপ, এনআরবি ব্যাংক ২০২৩ সালে ২৪০ মিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স সংগ্রহ করেছে, যা আগের বছরের তুলনায় তিন গুণ বেশি।
প্রবাসী বিনিয়োগের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব অর্থের বাইরে গিয়ে জ্ঞান হস্তান্তর, প্রতিষ্ঠানিক দক্ষতা ও বৈশ্বিক সংযোগ স্থাপনেও সহায়ক। তবে এখনও চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে—৩০% ফ্ল্যাট ট্যাক্স, বিনিয়োগের জটিল নিয়মকানুন, এবং রিয়েল এস্টেটের বাইরে বিনিয়োগের সীমিত সুযোগ অনেক সম্ভাবনাকে বাধাগ্রস্ত করছে।
বাংলাদেশ এখন স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের পথে। এ সময়টায় প্রবাসীদের বিনিয়োগ ও দক্ষতা দেশের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ। প্রবাসী নীতির উন্নয়ন, ফিনটেক উদ্ভাবন এবং বৈচিত্র্যময় খাতে বিনিয়োগের সুযোগ তৈরির মাধ্যমে প্রবাসীদের পুরো সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো সম্ভব হবে।
প্রবাসীরা এখন শুধু রেমিট্যান্সের উৎস নন, বরং তারা হয়ে উঠেছেন দেশের অর্থনীতির পুনর্গঠনের অংশীদার। সরকারের যুগোপযোগী নীতিমালা ও প্রযুক্তির সহায়তায় এনআরবি বিনিয়োগ আগামী দিনের উন্নয়নের অন্যতম ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
লেখক: আইনজীবী