১৮ জুলাই : যেদিন গুলিতে ঝাঁঝরা হয়েছিল ইয়ামিনের বুক

আজ ১৮ জুলাই। এক বছর আগে এই দিনেই সাভারের রাজপথে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের উত্তাল ঢেউ উঠেছিল। আষাঢ়ের ভ্যাপসা গরমে যখন হাজারো বিক্ষোভকারী নিজেদের অধিকারের দাবিতে মুখর, তখনই নির্মমভাবে ঝাঁঝরা করে দেওয়া হয়েছিল ইয়ামিনের বুক। বুলেটের আঘাতে নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল একটি প্রাণ, এক স্বপ্ন, এক মায়ের সন্তান।
২০২৪ সালের সেই ১৮ জুলাইয়ের কথা ভাবলে আজও গা শিউরে ওঠে। সেদিনের রাজপথ ছিল এক রণক্ষেত্র। একদিকে পুলিশ সাঁজোয়া যান থেকে টিয়ারশেল আর গুলি ছুড়ছিল, অন্যদিকে আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযোগী সংগঠনের লোকজন অস্ত্র হাতে আন্দোলনকারীদের মুখোমুখি হয়েছিল। এমন এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে অকালে ঝরে গিয়েছিল ইয়ামিনের জীবন।
গত বছরের ১৮ জুলাই ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পাকিজা ইউটার্ন এলাকায় অবস্থান নেয় বিপুল সংখ্যক পুলিশ ও বিজিবি সদস্য। আন্দোলনকারীরা তখন পুলিশকে লক্ষ্য করে স্লোগান দিচ্ছিলেন। এক পর্যায়ে টিয়ারশেল ছুড়লে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায় আন্দোলনকারীরা। ভাঙচুর হয় কয়েকটি পুলিশ ভ্যান।
দুপুর ২টা থেকে ২টা ২০ মিনিটের মধ্যেই ঘটনার মোড় ঘুরে যায়। পুলিশের গুলির মধ্যে আন্দোলনকারীদের রক্ষা করতে সাঁজোয়া গাড়ির ওপর উঠে পড়েন শাইখ আসহাবুল ইয়ামিন। খুব কাছ থেকে পুলিশের ছোড়া শটগানের গুলিতে ইয়ামিনের বুক ঝাঁঝরা হয়ে যায়। তারপর মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করা ইয়ামিনকে সেই সাঁজোয়া যান থেকেই রাস্তায় ফেলে দেওয়া হয়। হৃদয়বিদারক এই দৃশ্য মুহূর্তেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
শাইখ আসহাবুল ইয়ামিন ছিলেন এমআইএসটির (মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি) চতুর্থ বর্ষের কম্পিউটার সায়েন্সের মেধাবী শিক্ষার্থী। তার বাসা ছিল সাভারের ব্যাংক টাউন আবাসিক এলাকায়। জন্ম ২০০১ সালের ১২ ডিসেম্বর। সাভার ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করেছিলেন। বুয়েট ও রংপুর মেডিকেলে সুযোগ পেলেও ভর্তি হননি। ছাত্র রাজনীতির প্রতি সমালোচনামূলক মনোভাব ছিল তার। পড়তেন, জানতেন, বিতর্ক করতেন- ছিলেন এমআইএসটির বিতর্ক ক্লাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট।
শহীদ ইয়ামিনের বাবা মো. মহিউদ্দিন একজন সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা। তিনি বলেন, আমার এক ছেলে, এক মেয়ে। ইয়ামিন ছিল আমাদের আদরের। সেদিন জোহরের নামাজ পড়ে বাসা থেকে বের হয়ে আর ফেরেনি। এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছুটে গিয়ে ছেলের নিথর দেহ নিয়ে ফিরে এসেছিলাম।
ইয়ামিনের বাবা আরও বলেন, তালবাগ কবরস্থানে দাফনের ইচ্ছে ছিল, কিন্তু ময়নাতদন্ত ছাড়া অনুমতি দেওয়া হয়নি। পরে এক বন্ধুর সহায়তায় ব্যাংক টাউনের কবরস্থানে তাকে দাফন করি। কাফনের কাপড় ছাড়াই দাফন করি, কারণ আমি মনে করি, সে শহীদ হয়েছে। ইসলামেও শহীদদের রক্তমাখা কাপড়ই কাফন হিসেবে ধরা হয়।
মো. মহিউদ্দিন বলেন, আমি আমার ছেলের হত্যাকারীদের বিচার চাই। যেন আর কোনো বাবা-মা এমন কষ্ট না পায়, কোনো স্বপ্ন আর বুলেটের আঘাতে ভেঙে না পড়ে।
ইয়ামিন হত্যা মামলাটি এখন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন। মামলার তদন্তে ১০ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। গত ১২ জুলাই গুলি ছোড়ার অপরাধে কনস্টেবল মাহফুজকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি প্রাথমিকভাবে গুলি করার কথা স্বীকার করেছেন। আগামী ১২ আগস্ট তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার তারিখ ধার্য করেছেন আদালত।