সংস্কার-ন্যায়বিচারের পক্ষে ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে পোপ ফ্রান্সিসের ১২ বছর

ক্যাথলিক গির্জার প্রধান হিসেবে পোপ ফ্রান্সিস তার ১২ বছরের মেয়াদকালে ছিলেন শান্তি ও করুণার পক্ষের কণ্ঠস্বর। এ সময় তিনি ভ্যাটিকানের সরকার ব্যবস্থায় সংস্কার এনেছিলেন এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত শিশুদের নির্যাতনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছিলেন।
এএফপির দৃষ্টিতে আর্জেন্টাইন এই প্রধান ধর্ম যাজকের মেয়াদকালে তিনি যেসব সাফল্য অর্জন করেছিলেন এবং বিরোধিতার কারণে তিনি যেসব কাজ অমিমাংসিত রেখে গেছেন তার সারসংক্ষেপ তুলে ধরা হলো-
যৌন হেনস্তার বিরুদ্ধে লড়াই
২০১৩ সালে পোপ ফ্রান্সিস যখন দায়িত্ব বুঝে পান সে সময় সারা বিশ্বে ধর্মগুরুদের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগকে মোকাবিলা করা অন্যতম চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেয়।
২০১৮ সালে চিলি সফরের সময় ঘটা ঘটনাগুলো তার জন্য মোড় পরিবর্তন হিসেবে দেখা দেয়। পোপ ফ্রান্সিস চিলির একজন বিশপের বিরুদ্ধে এক বয়স্ক পুরোহিতের অপরাধ ধামাচাপা দেওয়ার অভিযোগের পক্ষে তার যুক্তি তুলে ধরেছিলেন। তিনি অভিযোগকারীদের সংঘটিত অপরাধ সম্পর্কে প্রমাণ উপস্থাপনের দাবি জানিয়েছিলেন। সে ঘটনায় পোপ ফ্রান্সিস ‘গুরুতর ভুল’ করার বিষয়টি স্বীকার করে নিয়েছিলেন, যা পোপের জন্য ছিল প্রথম ঘটনা। তিনি চিলির সব বিশপকে ভ্যাটিকানে তলব করেন। এ ঘটনার পর সবাই তাদের পদত্যাগপত্র জমা দেন।
সে বছরের শেষের দিকে পোপ ফ্রান্সিস নির্যাতনকারী মার্কিন ধর্মযাজক থিওডোর ম্যাককারিকের কাছ থেকে তার মূল উপাধি কেড়ে নেন। ২০১৯ সালে তিনি পুরোহিত হিসেবেও তার মর্যাদা প্রত্যাহার করে নেন। এছাড়া নির্যাতনে শিকার লোকজনের কথা শুনে ২০১৯ সালে এক নজিরবিহীন সম্মেলনে ধর্মীয়কাজে জড়িত লোকজনের নির্যাতনের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক লড়াই চালিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।
এরপর পুরো ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা হয়। ভ্যাটিকানের আর্কাইভ খোলা থেকে শুরু করে আদালতের অপব্যবহার এবং নির্যাতনের ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টার বিষয়ে গির্জা কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবেদন প্রকাশ বাধ্যতামূলক করার বিষয়গুলোতে তার অবদান ছিল উল্লেখ করার মতো।

তবে তার এসব উদ্যোগের সমালোচনাও ছিল। এ প্রসঙ্গে এন ব্যারেট ডোয়লে নামের একজন ক্যাম্পেইনার বলেছেন, তার এসব সংস্কার ছিল ‘অতিরঞ্জিত’।
কূটনীতি
পোপ ফ্রান্সিস তার ৪৭ বারের বিদেশ সফরে প্রান্তের দেশগুলোকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। এরমধ্যে রয়েছে সংখ্যালঘু ক্যাথলিক সম্পদায় অধ্যুষিত ছোট ছোট দেশগুলো।
অগ্নিগর্ভ হিসেবে পরিচিত সুদান, গাজা ও ইউক্রেনের মতো ইস্যুগুলোতে তিনি নিয়মিত শান্তির বাণী ছড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন, বিশেষ করে ইসলামসহ অন্য ধর্মে বিশ্বাসীদের সঙ্গে সংলাপকে গুরুত্ব দিতেন তিনি। নেপথ্যে থেকে কূটনৈতিক উদ্যাগের মাধ্যমে তিনি সমস্যার সমাধানে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছেন। এরমধ্যে ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও কিউবার সমস্যা সমাধানে মধ্যস্থতারও কারিগর তিনি। ২০১৮ সালে এক ঐতিহাসিক ও বিতর্কিত চুক্তির মাধ্যমে কমিউনিস্ট শাসিত চীনে বিশপ নিয়োগ করেন তিনি। তবে পোপ ফ্রান্সিস ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে উদ্যোগ নিলেও তা সফলতার আলো দেখেনি। এছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত থামাতে ইসরায়েলের সমালোচনার মুখেও তিনি ছিলেন সোচ্চার।
করুণা ও সামাজিক ন্যায়বিচার
পোপ ফ্রান্সিস ছিলেন উদারপন্থি, যিনি নিজের দলের সঙ্গে থাকতে পছন্দ করতেন। এই সর্বোচ্চ ধর্মযাজক চেষ্টা করেছিলেন উন্মুক্ত গির্জা গঠনের বিশেষ করে বিবাহিত, তালাকপ্রাপ্ত ও সমকামীদের জন্য।
পোপের এই উদ্যোগ সনাতনপন্থিদের ক্ষুব্ধ করেছিল। বিশেষ করে ২০২৩ সালের সমকামী জুটির জন্য আশীর্বাদের সিদ্ধান্ত অনেকেই ভালোভাবে নেননি।
আর্জেন্টিনায় ইতালির অভিবাসীর সন্তান ফ্রান্সিস অভিবাসীদের অধিকার রক্ষায় ছিলেন সোচ্চার। তিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে দলে দলে অভিবাসীদের বের করে দেওয়ার জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরিকল্পনার তীব্র সমালোচক ছিলেন। এছাড়া পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনে তার ছিল বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। তিনি জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বিত্তশালী দেশগুলোর বেশি দায় বহন করার পক্ষে ছিলেন।
সংস্কার
পোপ ফ্রান্সিস ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে ও স্বচ্ছতা বাড়াতে ভ্যাটিকানের সরকার ব্যবস্থায় মৌলিক সংস্কার এনেছিলেন। এ লক্ষ্যে তিনি ২০১৪ সালে বিশেষ সচিবালয় স্থাপন করেছিলেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে পোপ ফ্রান্সিস কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন। এ জন্য বিভিন্ন অভিযোগে ভ্যাটিকান ব্যাংকের পাঁচ হাজারেরও বেশি অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়।
তবে তার প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের বিরুদ্ধেও ছিল শক্ত বিরোধিতা। কেউ কেউ তার সংস্কারকে ‘অত্যাচারী’ আচরণ হিসেবেও সমালোচনা করেছেন।