গল্প
রাসেল ও ওলা পিঁপড়ে

বড় বড় কালো পিঁপড়েগুলোর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল রাসেল।
পিল পিল করে আসছে ওরা। কয়েকটা পিঁপড়ে। কয়টা?
উঁহু। রাসেল তো গুনতে জানে না। এখনো ঠিকমতো কথাই বলতে পারে না ও। আধো আধো বলে।
এই তো সেদিন। হাসু আপা কামালকে দেখিয়ে কত্ত করে বললেন, ‘বলো তো রাসেল এটা কে?’
ফিক করে হেসে ফেলল রাসেল। কিছুই বলল না।
খানিক বাদে জামালকে দেখিয়ে হাসু আপা বললেন, ‘বলো তো রাসেল এটা কে?’
এবারও রাসেল ফিক করে হাসল। কিছুই বলল না।
হাসু আপা তো হতাশ। নাহ। টোবলা টোবলা গাল দিয়ে শুধু মিষ্টি করে হাসতেই জানে ছেলেটা। ওর মুখ দিয়ে কথা বের করানো! সহজ কম্ম নয়।
এবার রেহানাকে দেখিয়ে হাসু আপা বললেন, ‘এ তোমার কী হয়?’
রাসেল কিন্তু এবার ফিক করে হাসল না। বলল, ‘আপু।’
তারপর মিষ্টি করে একটা হাসি দিল।
আর সঙ্গে সঙ্গে রাসেলকে কোলে তুলে নিলেন আপু। মানে রেহানা। হাসু আপারও খুব ইচ্ছে করছিল রাসেলটাকে কোলে নেন। তারপর টোবলা টোবলা গাল দুটো চুমোয় ভরিয়ে তোলেন। রেহানাও রাসেলের গালে চুমু দিতে চাইলেন। কিন্তু রাসেল সোনা এটা একেবারেই পছন্দ করে না। রেহানা আপুকে ঠেলে সরিয়ে দিল গালের কাছ থেকে।
রাসেলকে আবার বিছানার ওপর বসিয়ে দিলেন রেহানা আপু।
রেহানা আপু নিজেকে নিজে দেখিয়ে বললেন, ‘এটা কে?’
রাসেল মিষ্টি হেসে বলল, ‘আপু।’
এবার কামাল ভাইকে দেখিয়ে বললেন, ‘এটা কে?’
‘ভাই।’
খুশি হলেন কামাল। বললেন, ‘দেখেছিস, ভাইকে ঠিকই চিনতে পেরেছে।’
জামালকে দেখিয়ে এবার কামাল বললেন, ‘এটা কে?’
‘ভাই।’
হাসু আপাকে দেখিয়ে জামাল ভাই বললেন, ‘এটা কে?’
‘হাসুপা।’
এবার সবাই খুশিতে হইচই করে উঠলেন।
হাসুপা কামালকে দেখিয়ে বললেন, ‘এটা কামাল। বলো কামাল।’
রাসেল কী বুঝল কে জানে, ফিক করে হেসে বলল, ‘কামমাল।’
আবারও খুশিতে হইচই করে উঠলেন সবাই। কামাল খুশিতে গদগদ হয়ে বললেন, ‘বলেছে, বলেছে! আমার নাম বলতে পেরেছে!’
হাসুপা দেখলেন জামাল মলিন মুখে দাঁড়িয়ে আছে। এবার জামালকে দেখিয়ে বললেন, ‘এটা জামাল। বলো জামাল।’
রাসেলও ফিক করে হেসে বলে ফেলল, ‘জামমাল।’
তো সেই রাসেল পিঁপড়েগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর এদিক ওদিক তাকাল। উঁহু। কামমাল ভাই, জামমাল ভাই, আপু, হাসুপা-কেউ নেই আশপাশে। এই তো সুযোগ। খপ করে যেই একটা কালো পিঁপড়া ধরতে যাবে, অমনি হঠাৎ কোত্থেকে ছুটে এলেন হাসুপা। সঙ্গে সঙ্গে রাসেলকে কোলে তুলে নিলেন। তারপর কালো পিঁপড়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আহা। ওগুলো ওলা পিঁপড়ে। ওলা পিঁপড়ে ধরতে নেই। ধরলেই কামড়ে দেবে।’
বললেই হলো ধরতে নেই! ধরতে নেই বলার পরে পিঁপড়েগুলোর দিকে আবার তাকাল রাসেল। তখনো ও হাসুপার কোলে। কিন্তু মাথা ঝুঁকে তাকিয়ে আছে নিচে। গভীর মনোযোগ দিয়ে কালো পিঁপড়েগুলো দেখছে। যেন ওদের দাঁত খুঁজছে। নিশ্চয়ই ওদের দাঁত আছে, নইলে কামড়াবে কী দিয়ে?
হাসুপা রাসেলকে কোলে নিয়ে চলে গেলেন সোজা আম্মার কাছে। আম্মা তখন রান্নাঘরে। আব্বার জন্য নাশতা তৈরি করছিলেন। আব্বা বাড়িতে নেই। তবু আব্বার প্রিয় খাবার তৈরি করছেন আম্মা। আগে হাসুপা দেখতেন, আব্বার জন্য খাবার তৈরি করার সময় আম্মা একটু পরপর চোখ মুছতেন। চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় পানি পড়ত গড়িয়ে গড়িয়ে। এখন আম্মা কত শক্ত হয়ে গেছেন। আব্বার জন্য আর দেখিয়ে দেখিয়ে কাঁদেন না। কিন্তু কাঁদেন। সবার অগোচরে কাঁদেন। কেউ না বুজলেও হাসুপা বুঝতে পারেন।
রাসেল তখনো হাসুপার কোলে। মাকে খাবার তৈরি করতে দেখে বলে উঠল রাসেল, আব্বা...?
কথাটা শুনেই আম্মা তাকালেন হাসুপার দিকে। হাসুপাও অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন আম্মার দিকে। হাসুপার চোখে-মুখে কৌতূহল। আম্মার দিকে তাকিয়ে বললেন হাসুপা, ‘রাসেল কেমন করে বুঝল আম্মা?’
আম্মা বললেন, ‘জানি না।’
হাসুপা এবার রাসেলের টোবলা টোবলা দুই গালে দুটো চুমু দিয়ে বললেন, ‘আজ যে আমরা আব্বাকে দেখতে যাব, তুমি কেমন করে বুঝলে হে দার্শনিক?’
দার্শনিকই তো। দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলকে খুব ভালো লাগে আম্মার। আব্বার কাছ থেকে বার্ট্রান্ড রাসেলের গল্প শুনে শুনে আম্মাও তাঁর ভক্ত হয়ে গেছেন। সে জন্যই জন্মের পর আম্মা ছেলের নাম রাখলেন রাসেল। ভালোই হলো, তাঁদের ঘরেও একটা রাসেল আছে।
কিছুদিন আগে ছয় দফা দিয়ে গ্রেপ্তার হলেন আব্বা। আব্বা তাই বাড়িতে নেই। রাসেলের হাসিও যেন উধাও হয়ে গিয়েছিল। কেবল একটু একটু হাঁটতে শিখেছে রাসেল। টুকটুক করে হাঁটত। আর এ ঘর ও ঘর ঘুরে আব্বাকে খুঁজত। অনেকদিন পর আজ হঠাৎ হাসল। তাহলে ও নিশ্চয়ই টের পেয়ে গেছে, আজ আব্বাকে দেখতে যাবে ওরা। ১৫ দিন পরপর আব্বার সঙ্গে সবাই দেখা করতে যায়। কিন্তু রাসেল কী করে ১৫ দিনের হিসাব বুঝে গেল! ও তো এখনো গুনতেই জানে না!
দুপুরের পর আব্বার সঙ্গে দেখা করতে এলো সবাই। দূর থেকে আব্বাকে দেখেই খুশিতে লাফিয়ে উঠল রাসেল। তখনো হাসুপার কোলে ও। কোল থেকে নামার জন্য ছটফট করছিল। একটু পর হাসুপা ওকে নামিয়ে দিলেন কোল থেকে। আর নেমেই আব্বার কাছে ছুটে গেল রাসেল। কিন্তু আব্বা ওকে কোলে নিয়ে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরতে পারলেন না। মাঝখানে লোহার শিকগুলো বাধা হয়ে দাঁড়াল। তবু আব্বার কাছে কাছেই রইল রাসেল।
আব্বার সঙ্গে দেখা করার সময় শেষ। সবাই আব্বার কাছ থেকে বিদায় নিয়েছেন। কিন্তু রাসেল আসতে চাইল না। ওকে টেনেও আনা যাচ্ছিল না। দুই হাত দিয়ে দুটো লোহার শিক ধরে রাখল ও। খুব কান্নাকাটিও করতে লাগল।
রাসেলকে বোঝাতে শুরু করলেন হাসুপা, ‘শোনো রাসেল, তুমি তো স্মার্ট ছেলে। স্মার্ট ছেলেরা কি কোথাও বেড়াতে গেলে এরকম করে? যাব না, যাব না বলে চেঁচায়?’
আধো আধো ভাষায় জানতে চাইল রাসেল কিন্তু হাসুপা স্পষ্ট বুঝলেন। ‘আমরা কি বেড়াতে এসেছি?’
হাসুপা জবাব দিলেন, ‘হুঁ।’
‘আমি যাব না।’
‘এখন তো যেতে হবে রাসেল সোনা!’
‘আব্বা নিয়ে যাব। আব্বা এখানে কেন?’
কী জবাব দেওয়া যায় এবার রাসেলকে? রাসেল কি বুঝবে ছয় দফা দেওয়ার অপরাধে আব্বা এখানে? বাঙালির মুক্তি দাবি করার কারণে আব্বা জেলখানায় বন্দি?
হাসুপা বুদ্ধি করে বললেন, ‘এটাই তো আব্বার বাসা। আমরা আব্বার বাসায় বেড়াতে এসেছি। বেড়ানো শেষ এবার বাসায় ফিরে যাব।’
‘ও আচ্ছা।’
সবাই খুশি হলেন। যাক, রাসেল বুঝতে পেরেছে। এবার হাসুপা ওর হাত ধরে যেই কোলে নিতে যাবেন, অমনি আবার বেঁকে বসল রাসেল, ‘আমি থাকব। আব্বার বাসায় বেড়াব।’
বাসায় এসেও কান্নাকাটি করতে লাগল রাসেল, ‘আব্বার কাছে যাব। আব্বার কাছে যাব।’
কেউ ওকে থামাতে পারছিল না। আম্মা এসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘আমিই তো তোমার আব্বা। আমাকেই আব্বা বলে ডাকো।’
রাসেল কী বুঝল কে জানে, আম্মার গলা জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আব্বা।’
আর কি অবাক! ওর কান্নাও থেমে গেল।
এত্তকিছু বুঝতে পারে যে ছেলে, সে বুঝি কালো পিঁপড়ে বোঝে না!
আরেকদিন। সেদিনও কালো পিঁপড়ের সারিটার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল রাসেল। একটা কালো পিঁপড়ে ধরে দেখার খুব ইচ্ছে ওর। অনেকদিনের শখ। কিন্তু বড়রা কিছুতেই ওর ইচ্ছে পূরণ করতে দিচ্ছে না। কালো পিঁপড়েদের কাছে ওকে দেখলেই হলো। খপ করে ওকে কোলে তুলে নিয়ে যায়। ধ্যাৎ! বাড়িতে সবার ছোট বলে কি ইচ্ছেটাও পূরণ করতে পারবে না? তা হবে না। ওই তো কালো পিঁপড়ের সারি। সারিতে কয়টা পিঁপড়ে কে জানে। ও তো এখনো গুনতেই শেখেনি। যত কটাই হোক। একটা পিঁপড়ে ধরতে পারলেই হলো।
এদিক ওদিক তাকাল রাসেল। নাহ। কাউকে দেখা যাচ্ছে না। আশপাশে কেউ থাকলেই ঝামেলা।
থপ করে একটা কালো পিঁপড়ে ধরল ও। আর অমনি...
পিঁপড়েটা ঘাড় ঘুরিয়ে ওর হাতে দিল কামড়। আর অমনি...
‘ভ্যাঁ-এ-এ-এ-এ...’
সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে এলেন হাসুপা। আপু। কামমাল আর জামমাল ভাই। মায়ের অবশ্য সময় নেই। আব্বা জেলখানায় থাকলে মায়ের কাজ বেড়ে যায়। সংসার তো সামলাতে হয়ই, দলও সামলাতে হয়। রাসেলের দিকে মনোযোগ দেওয়ার সময় কোথায়?
হাসুপা এসেই দেখেন রাসেল ডানহাতটাকে ঝাঁকি দিচ্ছে। ঘটনা কী!
খপ করে রাসেলের হাত ধরে ফেললেন হাসুপা। তারপর চমকে উঠলেন। এ কি! একটা ওলা! বিরাট কালো পিঁপড়া। কামড়ে ধরে আছে রাসেলের ডান হাতের ছোট্ট বুড়ো আঙুলটা। পিঁপড়েটাকে টেনে আঙুল থেকে ছাড়িয়ে নিলেন হাসুপা। আর অমনি আঙুল কেটে রক্ত বেরোলো। সঙ্গে সঙ্গে রেহানাকে বললেন, ‘ওষুধ নিয়ে এসো!’
দেখতে দেখতে রাসেলের ছোট্ট আঙুলটা ফুলে গেছে। কান্নাও থামছে না। নিশ্চয়ই খুব ব্যথা করছে! করবেই তো। হাসুপা এবার বিড় বিড় করতে লাগলেন, ‘কতদিন নিষেধ করেছি, ওলা ধরতে হয় না। কে শোনে সে কথা? এখন?’
তার পর থেকে আর কখনো পিঁপড়ে ধরেনি রাসেল। তবে ওই পিঁপড়ের একটা নাম দিয়েছিল ও। ওর দেওয়া নাম শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিল সবাই। অবাক তো হবেই!
কারণ, রাসেল ওই রক্ত বের করা পিঁপড়ের নাম দিয়েছিল ‘ভুট্টো’।