শত বছরের নেত্রকোনার ‘বালিশ মিষ্টি’

দেখতে অনেকটা কোল-বালিশের মতো মনে হলেও তা কিন্তু নয়। আদতে রসালো সুস্বাদু মিষ্টি। স্বাভাবিক মিষ্টির চেয়ে আকৃতিতে বড়। এক-একটি মিষ্টির ওজন এক কেজি পর্যন্ত হয়। খাঁটি দুধের মিষ্টির ওপর আলতো করে প্রলেপ দেওয়া হয় ক্ষীরের। এটাই নেত্রকোনার শত বছরের ঐতিহ্যবাহী ‘বালিশ মিষ্টি’ নামে সুপরিচিত। কেবল জেলার ঐতিহ্য নয়, কালের পরিক্রমায় এর খ্যাতি ছড়িয়েছে দেশ-বিদেশেও।
নেত্রকোনায় বেড়াতে এলে রসনাতৃপ্তির জন্য সবাই চেখে দেখতে চান ‘বালিশ মিষ্টি’। খেয়েদেয়ে কেউ আবার সঙ্গে করে নিয়েও যান প্রিয়জনদের জন্য। উৎসবে কমতি নেই এর কদর। আর ঈদ কিংবা পূজা, জন্মদিন কিংবা বিয়ে যা-ই হোক, আপ্যায়নে চাই এই মিষ্টি।
যেভাবে এলো বালিশ মিষ্টি
জেলা শহরের বারহাট্টা রোডের গয়ানাথ ঘোষ নামের এক ব্যক্তি প্রায় ১১০ বছর আগে এ মিষ্টি প্রথম তৈরি করেন। দোকানে গয়ানাথ দুধ দিয়ে অনেক ধরনের মিষ্টি বানাতেন। এসব সনাতনী মিষ্টি কমবেশি শহরের সব দোকানিই বানাতে পারত। গয়ানাথ চিন্তা করলেন, নতুন কিছু করার। সে চিন্তা থেকেই দুধের ছানা দিয়ে পরীক্ষা করে নতুন একটা মিষ্টির কাঠামো তৈরি করলেন, যার আকৃতি দেখতে অন্য মিষ্টির চেয়ে অনেকটা বড় এবং কোল-বালিশের মতো।
মিষ্টি বানিয়ে লোকজনকে দেখালেন, খাওয়ালেন। স্বাদ দেখে মানুষ মিষ্টির নাম জানতে চাইলে বিড়ম্বনায় পড়েন গয়ানাথ। তিনি তো মিষ্টির কোনো নাম ঠিক করেননি। স্বজনদের সঙ্গে আলোচনা করেও নতুন মিষ্টির কোনো নাম ঠিক করতে পারলেন না গয়ানাথ। শেষে স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আবদুস সালাম পেয়ার মিয়া বালিশের মতো দেখতে মিষ্টিটির নাম দিলেন ‘বালিশ মিষ্টি’। পরে ধীরে ধীরে এ নামটিই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই ভারতে চলে যান গয়ানাথ ঘোষ। চলে যাওয়ার সময় তা শিখে নেন কারিগর ধীরেন্দ্র চন্দ্র মোদক। জীবিত থাকা অবস্থায় তিনি এ মিষ্টি তৈরির ধারা অব্যাহত রাখেন শ্রীকৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে। ধীরেন্দ্র চন্দ্র মোদকের মৃত্যুর পর তাঁর দুই ছেলে লিটন চন্দ্র মোদক ও দিলীপ চন্দ্র মোদক আজো ‘বালিশ মিষ্টি’র ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছেন। সে সঙ্গে নতুন করে আবিষ্কার করেছেন দুটি নতুন জামের সুস্বাদু মিষ্টি—‘জেলি কালোজাম’ ও ‘কেক দৈ’।
যেভাবে হয় বালিশ মিষ্টি
এখন ‘বালিশ মিষ্টির’ মূল কারিগর লিটন চন্দ্র মোদক। তিনি বলেন, ‘এ মিষ্টি তৈরি করতে প্রয়োজন মূল তিনটি উপাদান দুধ, চিনি ও ময়দা। প্রথমে দুধ থেকে তৈরি করা হয় ছানা। ছানা ও ময়দা দিয়ে তৈরি হয় মণ্ড, আর মণ্ড দিয়ে বানানো হয় মূল ‘বালিশ মিষ্টি’। সবশেষে চিনির সিরায় ভাজা হয় বালিশ। তৈরির সময় বালিশকে মুখরোচক করতে প্রয়োগ করা হয় বিশেষ কলাকৌশল। পরিবেশনের আগে বালিশের ওপরে এক ধরনের সুস্বাদু ঘন ক্ষীরের দুধ-মালাইয়ের প্রলেপ দেওয়া হয়।
বড় মিষ্টি অর্ডার দিয়ে বানাতে হয়। স্বাভাবিক তাপমাত্রায় গরমের দিন এ মিষ্টি তিন দিন এবং শীতের দিন সাত দিন পর্যন্ত ভালো থাকে।
লিটন চন্দ্র মোদক বলেন, ‘দেশি গাভীর খাঁটি দুধ ছাড়া বালিশ মিষ্টি বানানো হলে প্রকৃত স্বাদ পাওয়া যায় না। আমরা স্থানীয় বেপারীদের কাছ থেকে দেশি গাভীর দুধ কিনে থাকি। আমরা সঠিক মান ধরে রাখার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছি। এ মিষ্টি তৈরির সময় আমার সঙ্গে দিলীপ সরকার ও শঙ্কর সরকার নামের দুজন কারিগর নিয়মিত কাজ করে।’ তিনি আরো জানান, ভোর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত চলে কারখানায় ‘বালিশ মিষ্টি’ বানানোর কাজ।