ইশরাক হোসেনের গেজেট প্রকাশ ঝুলে যাচ্ছে?
বিএনপিনেতা ইশরাক হোসেনকে গত ২৭ মার্চ ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র হিসেবে বিজয়ী ঘোষণা করে রায় দিয়েছেন আদালত। কিন্তু, এখনও গেজেট প্রকাশ করেনি নির্বাচন কমিশন। সেজন্য, বৃহস্পতিবার (২৪ এপ্রিল) তিনি সিইসির সঙ্গে দেখা করেছেন। জানতে চেয়েছেন, আদালত তাকে মেয়র হিসেবে রায় দিলেও কেন গেজেট প্রকাশ করা হচ্ছে না।
নির্বাচন কমিশন ও ইশরাকের একাধিক সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। তবে, সিইসির কক্ষ থেকে বের হয়ে ইশরাক হোসেন বলেন, ‘আপনারা জানেন, নির্বাচনি ট্রাইব্যুনালের একটি রায় আমি পেয়েছি। সেই রায়ের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে এবং কীভাবে সেটিকে কার্যকর করা হবে, তা নিয়ে আলাপ করতেই আমি সিইসির সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।’
ইশরাক হোসেন আরও বলেন, ‘পরবর্তী কার্যক্রম বলতে আদালত থেকে এখানে (ইসি) ফাইল এসেছে। তারপর একটা গেজেট হবে। এর একটা টাইমফ্রেম আছে। তারপর গতকালের নিউজ আপনারা জানেন, ইসি আইন মন্ত্রণালয়ে একটি মতামত চেয়েছেন। সেটারই একটা ফলোআপ করতে আমরা এখানে এসেছি।’
ইশরাক হোসেনের উদ্দেশে বলা হয়, ভোটের সময় আপনারা বলেছিলেন, এটি অবৈধ সরকারের আমলে অবৈধ নির্বাচন হচ্ছে। সেই নির্বাচনের মেয়র হিসেবে আদালত আপনার পক্ষে রায় দিয়েছেন। জবাবে ইশরাক হোসেন বলেন, ‘আমি কী বলেছিলাম, তার থেকে মোর ইম্পরটেন্ট হচ্ছে; মামলা করার সময় আমি কী আর্জি করেছি। আমরা নির্বাচনি ফলাফল ও গেজেট বাতিল চেয়ে আবেদন করেছিলাম।’
জানতে চাইলে আজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ এ প্রতিবেদককে বলেন বলেন, ‘আমরা আইন মন্ত্রণালয়ের কাছে গেজেট সংক্রান্ত বিষয়ে পরামর্শ চেয়েছি। দেখি, তারা কী মতামত দেন। সে পর্যন্ত অপেক্ষা করি। সব সিটি করপোরেশনের মেয়রদের অপসারণ করে গত বছরের ১৯ আগস্ট প্রজ্ঞাপন জারি করেছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। একটি অপসারিত স্থানে আরেকজনকে মেয়র হিসেবে ঘোষণা করতে হবে। সেজন্য, আমাদের পরামর্শ চাওয়া।’
এক প্রশ্নের জবাবে আখতার আহমেদ বলেন, ‘আইন মন্ত্রণালয় থেকে মতামত আসুক বা না আসুক, কমিশনকে একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কারণ, ইসির সিদ্ধান্ত ছাড়া তো গেজেট প্রকাশিত হবে না। আমরা তো আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করিনি। ফলে, দেখা যাক কি হয়।’
তবে ইসির একটি সূত্র জানিয়েছে, ২০২৪ সালের ১ অক্টোবর চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) নির্বাচনে বিএনপির মেয়র প্রার্থী শাহাদাত হোসেনকে জয়ী ঘোষণা করেন আদালত। ৮ অক্টোবর ইসি তাকে মেয়র ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ করে ইসি। সে সময় আইন মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ নেয়নি সাংবিধানিক এ প্রতিষ্ঠানটি। ফলে, এবারও ইসি চাইলে আইনকানুন দেখে ইশরাককে মেয়র ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ করতে পারত।
যদিও ইসির আরেকটি সূত্র বলছে, সিটি করপোরেশনের মেয়রদের অপসারণ করে প্রজ্ঞাপন জারির অর্থ হচ্ছে, পদটি শূন্য হওয়া। শূন্য পদে সাধারণত উপনির্বাচন হয়। সুতরাং, শূন্য পদে নতুনভাবে গেজেট করা নিয়ে একটি আলোচনা থাকার কথা।
অন্যদিকে ইশরাক হোসেনের ঘনিষ্ট একটি সূত্র দাবি করেছে, আদালতের রায় ঘোষণার সাত দিন পর বিএনপির নেতা শাহাদাত হোসেনকে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করে ইসি। তাহলে এখানে কেন আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত নেওয়ার প্রয়োজন দেখা দিল? এ বিষয়ে ইসির ব্যাখ্যা হচ্ছে, তখন নির্বাচন কমিশন নিয়োগ হয়নি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সূত্রটি বলছে, সম্প্রতি ইশরাকের পক্ষে আইন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার কার্যালয়ে যোগাযোগ করা হয়। সেখান থেকে বলা হয়, বিষয়টি নিয়ে সরকারের ঊর্ধ্বতনরা আলোচনা করছেন। সম্ভবত সরকারের কোনো একটি পক্ষ নির্বাচন কমিশন গেজেট প্রকাশ করুক, তা চায় না। কোনো একটি ঝামেলা এখানে রয়েছে।
সূত্রটির দাবি, তার জানা মতে, বৃহস্পতিবার (২৪ এপ্রিল) আইন মন্ত্রণালয় থেকে ইসির কাছে মতামত দেওয়ার কথা থাকলেও তা দেওয়া হয়নি। আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল নিজে বৃহস্পতিবার অফিস করেননি। ইসি থেকেও আমাদের বলা হয়েছে, আইন মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করতে।
যদিও সূত্রটির এসব দাবির সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
সূত্রটি বলছে, ঢাকার প্রথম যুগ্ম জেলা জজ ও নির্বাচনি ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. নুরুল ইসলাম ২৭ মার্চ এ রায় দিলেও পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন ১৬ এপ্রিল। আদেশে বলা হয়, ১০ দিনের মধ্যে গেজেট প্রকাশ করতে নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশ দেওয়া হয়। আগামীকাল শুক্রবার (২৫ এপ্রিল) সেই ১০ দিন শেষ হচ্ছে। তার মানে, ১০ দিনের মধ্যে গেজেট প্রকাশ করা কঠিন। গেজেট প্রকাশ ঝুলেও যেতে পারে, এটা আমাদের আশঙ্কা। কারণ, কোনো এক পক্ষের এটি নিয়ে আপত্তি রয়েছে।
ইশরাক হোসেনের ঘনিষ্ট ওই সূত্রটি দাবি করেছে, তারা ইসির আইন শাখায়ও যোগাযোগ করেছেন। আইন শাখার প্রত্যাশা, আগামী রোববার অথবা সোমবারের মধ্যে আইন মন্ত্রণালয় থেকে মতামত পাওয়া যাবে। যদিও সূত্রের আশঙ্কা, এর মধ্যে মন্ত্রণালয় থেকে মতামত নাও আসতে পারে। মানে, প্রক্রিয়াটি ঝুলে যেতে পারে।
গত ২৭ মার্চ আদালতের রায়ের দিন ইশরাক হোসেনের আইনজীবী রফিকুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, ২০২০ সালে ১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনের প্রার্থী ইশরাক হোসেনের গাড়িবহরে হামলা করা হয়, ইভিএম মেশিনে ভোট জালিয়াতি করা হয়, নির্বাচনে ভোটারদের ভোটগ্রহণে বাধা দেওয়া হয়, কেন্দ্র থেকে এজেন্টদের বের করে দেওয়া হয় ও নির্বাচনে ভোট জালিয়াতি করা হয়। এতসব জালিয়াতির পরেও নির্বাচন কমিশন ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসকে মেয়র ঘোষণা করে। নির্বাচন কমিশনের গেজেট চ্যালেঞ্জ ও নির্বাচনি ফলাফল বাতিল চেয়ে ২০২০ সালের ৩ মার্চ ইশরাক হোসেন বাদী হয়ে মামলা করেন। আদালত পূর্ণাঙ্গ শুনানি নিয়ে ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ঘোষণা করেন।
তবে ইসি সূত্র বলছে, ইশরাক হোসেন নির্বাচন ও গেজেট বাতিলের দাবিতে নির্বাচনি ট্রাইবুনালে মামলা করেন। তাকে বিজয়ী ঘোষণার জন্য মামলা করা হয়নি। দেখা যাক, কমিশন কী সিদ্ধান্ত নেয়।
আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে ২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ডিএসসিসি নির্বাচনে মেয়র পদে নির্বাচিত হন সাবেক সংসদ সদস্য শেখ ফজলে নূর তাপস। এরপর গত ২৭ ফেব্রুয়ারি শপথ নেন তিনি।
স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন-২০০৯ অনুযায়ী, মেয়র হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথম বোর্ড সভা থেকে তাপসের মেয়াদকাল শুরু হয়েছিল। অর্থাৎ নতুন মেয়র যেদিন কাউন্সিলরদের নিয়ে প্রথম সভা করেছিলেন, সেদিন থেকেই শুরু হয়েছিল তার ৫ বছরের মেয়াদকাল। সে হিসেবে ২০২০ সালের ২ জুন নগর ভবনের মেয়র মোহাম্মদ হানিফ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত করপোরেশনের দ্বিতীয় পরিষদের প্রথম করপোরেশন সভা অনুষ্ঠিত হয়। অর্থাৎ, ২০২৫ সালের ১ জুন পর্যন্ত শেখ ফজলে নূর তাপসের মেয়াদকাল থাকার কথা ছিল।