৭৪ শতাংশ বিদ্যুৎ কয়লা-নির্ভর, প্রশ্নবিদ্ধ ভারতের জ্বালানি সাফল্য

নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে জীবাশ্ম-বহির্ভূত জ্বালানিকে দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার অর্ধেকের বেশি উন্নীত করেছে ভারত। তবে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনকারী এই দেশ বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য এখনো কয়লার ওপর নির্ভরশীল। খবর বার্তা সংস্থা এএফপির।
গত জুলাই মাসে দেশের এই অর্জন প্রকাশ হওয়ার পর নবায়নযোগ্য জ্বালানি মন্ত্রী প্রহ্লাদ যোশী এটিকে ‘ভারতের জ্বালানি রূপান্তর যাত্রার একটি মাইলফলক’ হিসেবে ঘোষণা করেন। তিনি জানান, প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী ২০৩০ সালের যে লক্ষ্যমাত্রা ছিল, তা পাঁচ বছর আগেই অর্জন করা সম্ভব হয়েছে।
তবে জলবায়ু বিশেষজ্ঞ অবন্তিকা গোস্বামী বলেন, এই পরিসংখ্যান কেবল সম্ভাব্য বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার কথা বলে। যা গল্পের একটি অংশ মাত্র। দিল্লিভিত্তিক সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের (সিএসই) এই বিশেষজ্ঞ এএফপিকে বলেন, ‘সামগ্রিকভাবে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে প্রকৃত বিদ্যুৎ উৎপাদন এখনও বেশ কম। এর কারণ হলো, দেশের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ বিদ্যুৎ এখনো দূষণকারী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে আসে।
ভারত যখন বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কয়লার ওপর এতটা নির্ভরশীল তখন দেশটির জ্বালানি রূপান্তরের মাইলফলক অর্জনের ঘোষণা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।
কয়লার ওপর নির্ভরতা
কয়লার ওপর ভারতের ক্রমাগত নির্ভরতা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। গত বছর ভারত কয়লার ব্যবহার কমানোর পরিবর্তে এর উৎপাদন ৫ শতাংশ বাড়িয়ে ১ বিলিয়ন টন করেছে। দেশটির কয়লা মন্ত্রণালয় জানায়, বিদ্যুৎ চাহিদার জন্য কয়লা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মন্ত্রণালয় এটিকে ‘ভারতের কয়লা সমৃদ্ধি’ হিসেবে বর্ণনা করে বলছে, দেশের মোট বিদ্যুতের ৭৪ শতাংশের বেশি সরবরাহ করে কয়লা খাত।
বিশ্বে কার্বন নিঃসরণে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের পরে তৃতীয় স্থানে রয়েছে ভারত। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, ১৪০ কোটিরও বেশি জনসংখ্যার এই দেশে মাথাপিছু কার্বন নিঃসরণ বৈশ্বিক গড়ের মাত্র এক-তৃতীয়াংশ। জলবায়ু কর্মী হারজিৎ সিং বলেন, মাথাপিছু কার্বন নিঃসরণের হিসেবে ভারত বেশ ভালো করছে।
২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ ৪৫ শতাংশ কমানোর একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ ভারতের সামনে রয়েছে। একই সময়ে ২০৪৭ সাল নাগাদ দেশের বিদ্যুতের চাহিদা দ্বিগুণেরও বেশি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

বিদ্যুৎ সংরক্ষণ ও সমাধান
ভারতের ৪৮৪ দশমিক ৮ গিগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার অর্ধেক আসে জীবাশ্ম-বহির্ভূত উৎস থেকে। এর মধ্যে সৌরশক্তি থেকেই আসে ১১৯ গিগাওয়াট, যা বিশ্বে তৃতীয় সর্বোচ্চ। ভারত সিঙ্গাপুরের আয়তনের একটি মরুভূমিতে বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম সৌর ও বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে।
তবে সৌর ও বায়ু থেকে তখনই বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় যখন আবহাওয়া অনুকূল থাকে। কিন্তু ভারতের বিদ্যুৎ সংরক্ষণের ক্ষমতা মাত্র ৫০৫ মেগাওয়াট-ঘণ্টা, যা চাহিদার তুলনায় অনেক কম। নবায়নযোগ্য জ্বালানি মন্ত্রী যোশী নিজেও এই সমস্যার কথা স্বীকার করে বলেন, সংরক্ষণাগার ছাড়া আমাদের হয় এই শক্তি নষ্ট করতে হবে, অথবা যখন নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদন কমে যাবে তখন আবারও কয়লার ওপর নির্ভরশীল হতে হবে।
ব্যাটারিভিত্তিক সংরক্ষণাগার তৈরির জন্য বিরল খনিজ পদার্থ প্রয়োজন, যার ৭০ শতাংশ সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে চীন। এই বিষয়ে জলবায়ু কর্মী হারজিৎ সিং বলেন, আমরা এখনও চীনের ওপর নির্ভরশীল। এই বিষয়ে আলোচনা করতে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই সম্প্রতি নয়াদিল্লি সফর করছেন।

ভারত আরেকটি সমাধান হিসেবে পাম্প-হাইড্রো জ্বালানি সংরক্ষণ প্রকল্প নিয়েও চিন্তা করছে। যখন সৌর ও বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্র অতিরিক্ত শক্তি উৎপাদন করে, তখন পানি উচ্চ জলাধারে পাম্প করা হয়। পরে যখন বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ে, তখন সেই সঞ্চিত শক্তি দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। গোস্বামী বিশ্বাস করেন, পরিচ্ছন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বহুমুখী কৌশল প্রয়োজন।