পাকিস্তানি মায়ের কোল ছাড়তে হচ্ছে ভারতীয় শিশুদের

তপ্ত দুপুরে, কালো বোরকার অন্তরালে ব্যাকুল এক মায়ের আকুতি। স্বামীর হাতের শেষ স্পর্শটুকু আঁকড়ে ধরার প্রাণান্তকর চেষ্টা। সায়রা আর ফারহান, ভারত ও পাকিস্তানের প্রধান সীমান্ত চৌকি আটারি-ওয়াঘার ধূসর প্রান্তরে দাঁড়িয়ে, যেন সময়ের কাছে মিনতি জানাচ্ছিলেন—থেমে যাক এই বিচ্ছেদের ক্ষণ।
এই সেই সীমান্ত, যা একদিন দুই প্রতিবেশীর হৃদয়ের সংযোগ স্থাপন করেছিল, আজ তা নির্মম বিচ্ছেদের নীরব সাক্ষী। হাজারো পরিবার, যাদের রক্তে মিশে আছে দুই দেশের পরিচয়, আজ কেবলই দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গী। সায়রা ও ফারহানের মতো কত যুগল, যাদের স্বপ্নগুলো সীমান্তের কাঁটাতারে আটকে যাচ্ছে।
কাশ্মীরের পহেলগামে নৃশংস হামলার পর ভারত সরকারের আকস্মিক নির্দেশে পাকিস্তানি নাগরিকদের অবিলম্বে দেশ ছাড়তে হচ্ছে। সায়রা ও ফারহানও তাদের নয় মাসের বুকের ধন আজলানকে নিয়ে নয়াদিল্লি থেকে রওনা হয়েছিলেন। করাচির সায়রা প্রেমের টানে তিন বছর আগে নয়াদিল্লির ফারহানের সঙ্গে ঘর বেঁধেছিলেন। কিন্তু সীমান্তের নিষ্ঠুর নিয়তি তাদের সুখের নীড় ভেঙে দিল।
বিদায় বেলায় সায়রার ভেজা চোখের গভীরে ছিল, না বলা কষ্টের সমুদ্র। ফারহানের আলিঙ্গন যেন সময়ের শেষ স্পর্শ। কিন্তু সীমান্তরক্ষীর কঠোর চাহনি তাদের সেই স্পর্শ ভেঙে দিল। কাঁটাতারের বেড়া আর ব্যারিকেডের ওপারে তাদের একমাত্র পরিচয়—সায়রার সবুজ পাসপোর্ট, আর ফারহানের নীল।
‘আমরা আবার মিলিত হব’, ফারহান তার ছোট্ট ছেলে আজলানের নরম গালে শেষ চুমুটি এঁকে সায়রার কানে ফিসফিস করে বললেন। সায়রা যখন তার কলিজার টুকরাকে নিয়ে সীমান্ত পেরোনোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখনই এক অপ্রত্যাশিত বাধা। সীমান্ত রক্ষীর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আজলানের নীল পাসপোর্টের ওপর স্থির হলো। ‘বাচ্চাটি নয়, ম্যাডাম, আপনি একা যাবেন।’ এটি কর্তৃপক্ষের ঘোষণা।
মুহূর্তেই ছিন্ন হলো ভালোবাসার বন্ধন। সায়রা চললেন করাচির পথে, আর ফারহান ও তাদের দুধের শিশু আজলান ফিরে চললেন শূন্য নয়াদিল্লির দিকে।
এ যেন এক অন্তহীন নির্বাসন
গত ২২ এপ্রিল পেহেলগামে নৃশংস হামলায় ২৬ জন বেসামরিক নাগরিককে গুলি করে হত্যা করা হয়। যাদের বেশিরভাগই ছিল পর্যটক। এ ঘটনায় পর থেকেই দুই দেশের সম্পর্কের শেষ সুতোটুকুও ছিঁড়ে দিল। এ ঘটনায় ভারত পাকিস্তানকে অভিযুক্ত করেছে। ইসলামাবাদ সেই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। কিন্তু এ নিয়ে পারমাণবিক শক্তিধর দুই প্রতিবেশীর মাঝে যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব। সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত, কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন—যেন এক অন্তহীন সংঘাতের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে দুই দেশকে।
গত ২২ এপ্রিল থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ৭৫০ জন পাকিস্তানি পাসপোর্টধারী সীমান্ত পেরিয়ে দেশে ফিরেছে। অন্যদিকে প্রায় এক হাজার ভারতীয় সীমান্ত পার হয়ে ফিরেছেন ভারতে।
এই পরিস্থিতিতে সীমান্তের দুপাশে আটকে পড়েছে হাজারো পরিবার। তাদেরই একজন হালিমা বেগম। যিনি পঁচিশ বছর আগে ভালোবেসে ঘর ছেড়েছিলেন। বিয়ে করেছিলেন ওড়িশার এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীকে। আজ তিনি নিজভূমেও পরবাসী। তার দুই সন্তান, যাদের নীল পাসপোর্ট মায়ের সবুজ পরিচয়ের সঙ্গে মেলেনি, মায়ের একাকী যাত্রার আজ তারা অসহায় সাক্ষী।
‘আমার মনে হাজারটা প্রশ্ন, কোনো উত্তর নেই’,—বললেন হালিমা। তার কান্নার রোল যেন সীমান্তের নীরবতা ভেঙে খান খান করে দিচ্ছিল। তিনি জানান, একজন পুলিশ সদস্য ভারত সরকারের ‘ভারত ছেড়ে দিন’ নোটিশ দেওয়ার আগে জীবন মোটামুটি ভালোই ছিল।

হালিমা দুঃখ প্রকাশ করে বলছিলেন, আমি খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আমি তাদের (পুলিশদের) বলেছিলাম, আমি এখানে আসিনি, ভারতে আমার বিয়ে হয়েছে। আমার জীবন উপড়ে ফেলে আমাকে তাড়িয়ে দেওয়া কি (ভারত) সরকারের ন্যায়সঙ্গত কাজ?
হালিমার সঙ্গে তার দুই ছেলে, ২২ বছর বয়সী মুসাইব আহমেদ এবং ১৬ বছর বয়সী জুবায়ের আহমেদ ছিলেন। আট বছর আগে তার স্বামী মারা গেছেন। বাচ্চারা সিদ্ধান্ত নেয়, জুবায়ের তাদের মায়ের সঙ্গে থেকে তার দেখাশোনা করবে।
কিন্তু দুই সন্তানেরই পাসপোর্ট নীল, তাদের মায়ের সবুজ পাসপোর্টের মতো নয়। তারা সীমান্তরক্ষীদের কাছে আবেদন করে, এক পর্যায়ে তর্ক করে। কিন্তু কিছুতেই কাজ হয়নি। ছেলে মুসাইব হালিমার আসন্ন করাচি-যাত্রার কথা উল্লেখ করে বলেন, তিনি কখনো একা ভ্রমণ করেনি, আমি জানি না তিনি কীভাবে এটি করবেন।
তবে করাচিতে পৌঁছানোর পর হালিমা কোথায় যাবেন তা তিনি জানেন না। কারণ সেখানে তার কোনো বাড়ি নেই। হালিমা বলছিলেন, আমার বাবা-মা অনেক আগেই মারা গেছেন। একমাত্র ভাই তার ছয় সদস্যের পরিবারের সঙ্গে দুটি ঘরে থাকে।
হালিমা চোখের পানি মুছতে মুছতে বলেন, আমার মনে হাজারও প্রশ্ন আছে, কোনো উত্তর নেই। আমি কেবল স্রষ্টার কাছে শিশুদের নিরাপত্তার জন্য প্রার্থনা করি।
হালিমা, কিংবা সায়রা বা ফারহানের মতো অসংখ্য পরিবার, যারা হয়তো আর কখনোই একে অপরের মুখ দেখবেন কিনা জানেন না। সীমান্তের কাঁটাতার তাদের ভালোবাসার পথে এক নির্মম প্রাচীর গড়ে তুলেছে। তাদের চোখের জল, বুকের হাহাকার—যেন এক নীরব আর্তনাদ, যা হয়তো কোনোদিনই শোনা হবে না। তবে তারা আশা প্রকাশ করছেন— শিগগিরই মিলিত হতে পারবেন তারা।