পারমাণবিক ইস্যুতে আলোচনা : ইরান-যুক্তরাষ্ট্র কোন দেশ কী চায়?

ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে দেশটির সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুই দফায় ‘গঠনমূলক’ আলোচনা হয়েছে। ওমানের রাজধানী মাসকাটে প্রথম বৈঠকের এক সপ্তাহ পর শনিবার (১৯ এপ্রিল) ইতালির রোমে দ্বিতীয় দফা আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এতে মধ্যস্থতা করে ওমান। খবর আলজাজিরার।
আগামী বুধবার ওমানে ‘টেকনিক্যাল আলোচনা’ শুরু হবে বলে আশা করা হচ্ছে, এরপর চুক্তির কাছাকাছি পৌঁছার জন্য আরও উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। তাহলে এই টেকনিক্যাল আলোচনার বিষয়গুলো কী এবং কী ধরনের চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনা আছে?
টেকনিক্যাল আলোচনার বিষয়গুলো কী
বুধবার উভয় পক্ষের বিশেষজ্ঞরা ইরানে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের অভ্যন্তরীণ কার্যক্রম এবং এর সঙ্গে দেশটির পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পর্কিত বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা শুরু করবেন।
ইরানের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞাগুলো জটিল ও বহু স্তরের। বুধবারের ওই আলোচনায় ইরানকে তার পারমাণবিক কর্মসূচির বিষয়ে গ্রহণ করতে বলা প্রতিটি পদক্ষেপ বা নিশ্চয়তার সঙ্গে নিষেধাজ্ঞার স্তরগুলোকে পর্যালোচনা করতে হবে। এই আলোচনার তিন দিন পর মাসকাটে আরও একটি উচ্চ পর্যায়ের আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে।
সর্বশেষ দুই দফার বৈঠকে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি ও মার্কিন বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফের মধ্যে পরোক্ষ আলোচনা হয়, যেখানে ওমানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বদর আলবুসাইদির মাধ্যমে বার্তা বিনিময় করা হয়।
ইরানের পরমাণু আলোচনা যেভাবে এই পর্যায়ে পৌঁছাল
পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে আলোচনায় না বসলে তেহরানকে হামলার হুমকি দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এরপর থেকে শুরু হওয়া এই আলোচনার অগ্রগতি নিয়ে কর্মকর্তারা আশাবাদী।
মার্চের শুরুর দিকে ট্রাম্প বলেন, তিনি ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিকে চিঠি লিখে দেশটির পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে আলোচনার আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু চিঠিটি সংযুক্ত আরব আমিরাতের মাধ্যমে পাঠানো হয়েছিল এবং ট্রাম্পের ঘোষণার প্রায় এক সপ্তাহ পরে সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্টের কূটনৈতিক উপদেষ্টা আনোয়ার গারগাশ এটি তেহরানে পৌঁছে দেন।
ট্রাম্পের চিঠি এখনও পাওয়া যায়নি জানিয়ে আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি এক ঘোষণায় বলেছিলেন, ইরান ‘মাস্তানি করা সরকারগুলোর দাবি’ মেনে নেবে না। কিন্তু পরে ওমানের মধ্যস্থতায় ইরান পরোক্ষ আলোচনায় রাজি হয়। মজার বিষয় হলো ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে আগের পারমাণবিক চুক্তিরও মধ্যস্থতাকারী ছিল ওমান।

ইরান কি পারমাণবিক অস্ত্র চায়?
ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির পরিকল্পনা করার কোনো ইঙ্গিত দেয়নি। প্রকৃতপক্ষে, দেশটির সর্বোচ্চ নেতা বহু বছর আগে একটি ধর্মীয় ফরমান জারি করে এই ধরনের অস্ত্রের তৈরির প্রচেষ্টা নিষিদ্ধ করেন।
ট্রাম্পের হুমকি পাওয়ার পর খামেনি বলেছিলেন, ইরান যদি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির চেষ্টা করে, তাহলে তা কেউ থামাতে পারবে না। তবে, তিনি এটি নিষিদ্ধের ডিক্রি বাতিল করেননি।
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি সীমিত করার জন্য কি ইতোমধ্যে কোনো চুক্তি হয়নি?
২০১৫ সালে ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি বা যৌথ ব্যাপক কর্মপরিকল্পনা (জেসিপিওএ) ছিল সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রশাসনের একটি কূটনৈতিক জয়। ওই চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, ইরান কিছু পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা থেকে মুক্তির বিনিময়ে তার পারমাণবিক শক্তি কর্মসূচি নিয়মিত পরিদর্শনের সুযোগ দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তবে ট্রাম্প তার প্রথম মেয়াদে ২০১৮ সালের মে মাসে জেসিপিওএ বা পারমাণবিক চুক্তি থেকে সরে গিয়ে ইরানের ওপর শাস্তিমূলক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন।
যুক্তরাষ্ট্র আসলে কী চায়?
সাম্প্রতিক দুই দফার আলোচনায় একটি বিষয় উঠে এসেছে, তা হলো ইরানের সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের পরিমাণ কত এবং কোন স্তরে আছে। সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম পারমাণবিক শক্তি চুল্লির জন্য ব্যবহৃত হয়, তবে এটি সাধারণত ৩ থেকে ৫ শতাংশের পর্যন্ত সমৃদ্ধ করা হয়।
আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা আইএইএর তথ্যমতে, ইরানের কাছে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম রয়েছে ২৭৪ দশমিক ৮ কেজি (৬০৫ দশমিক ৮ পাউন্ড)। অস্ত্র তৈরির জন্য ইউরেনিয়ামকে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত সমৃদ্ধকরণের প্রয়োজন হয়।
জেসিপিওএর আওতায় ইরান ৩ দশমিক ৬৭ শতাংশ পর্যন্ত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করতে পারে এবং ৩০০ কেজি (৬৬১ পাউন্ড) পর্যন্ত মজুত রাখতে পারে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিশেষ দূত উইটকফ বলেছেন, ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের গ্রহণযোগ্য স্তর হবে ৩ দশমিক ৬৭ শতাংশ, যা ওবামার আমলে করা চুক্তিতেও উল্লেখ ছিল।
তাহলে ট্রাম্প কেন আরেকটি চুক্তি চান?
ট্রাম্পের মন পড়া কঠিন। কিন্তু তার ভাষ্য অনুযায়ী, তিনি নিজেকে একজন চুক্তি সম্পাদনকারী হিসেবে দেখেন, যিনি প্রয়োজনে যে কারও সঙ্গে কথা বলতে প্রস্তুত। এমনকি, যদি তিনি শেষেরটির মতোই একটি চুক্তিতে পৌঁছেন।
ট্রাম্প ২০১৮ সালে ইসরায়েলের মন্তব্যে প্রভাবিত হয়ে পারমাণবিক চুক্তি থেকে সরে গিয়েছিলেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। ওই সয় তিনি বলেছিলেন, জেসিপিওএ একটি ‘খারাপ চুক্তি’।
ইসরায়েল দীর্ঘদিন ধরে ইরানকে শত্রু হিসেবে বিবেচনা করে আসছে। দেশটি দাবি করছে, ইরান গোপনে পারমাণবিক বোমা তৈরির চেষ্টা করছে এবং তারা বড় আঞ্চলিক হুমকি।
আন্তর্জাতিক পারমাণবিক সংস্থার পরিদর্শন শুরু হওয়ার পর থেকে ইরান চুক্তিটি মেনে চলছে। তবে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে জেসিপিওএ থেকে প্রত্যাহারের পর ইরান তাদের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের মাত্রা বাড়িয়েছে।
তাহলে কোনো চুক্তি হবে কি?
এটা এখনই বলার জন্য খুব অল্প সময়। আশাব্যঞ্জক লক্ষণ হলো ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি দলগুলো দ্বিতীয় দফা আলোচনায় অন্তত কিছু সময়ের জন্য একই কক্ষে ছিল এবং কৌশলগত আলোচনায় অগ্রগতি হয়েছে বলে প্রতিবেদন এসেছে।
ইরানের আধা-সরকারি সংবাদ সংস্থা তাসনিম জানায়, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি বলেছেন, ‘আমরা কিছু নীতি ও লক্ষ্য নিয়ে আরও ভালো বোঝাপড়ায় পৌঁছাতে পেরেছি।’
শনিবার আরাঘচি সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করেন, ‘আপাতত, আশাবাদী নিশ্চিত, তবে প্রচুর সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।’
ইরান জোর দিয়ে বলেছে, যুক্তরাষ্ট্র এই চুক্তি মেনে চলবে, তার নিশ্চয়তা দিতে হবে। অন্যদিকে, ইরানের পারমাণবিক শক্তি কর্মসূচি পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ বন্ধে জোর দেয় যুক্তরাষ্ট্র।