স্বাধীন ভাবনা
‘বাংলাদেশ নিয়ে বড় স্বপ্নই দেখি’

বাংলাদেশ বিশ্বের মানচিত্রে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ। যাদের প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছিল আজকের এই স্বাধীনতা, তাদের বেশির ভাগই ছিলেন বাংলার তরুণ দামাল সন্তান। দেশ ও জাতির ক্রান্তিকালে এ দেশের তরুণরাই সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। আমাদের জাতিগত যতটুকু অর্জন তার মূলে রয়েছে তারুণ্যের অদম্য ও ঐক্যবদ্ধ শক্তি। তাই আজ বিজয়ের মাসে আমরা তুলে ধরব উত্তরবঙ্গের অন্যতম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষার্থীদের স্বাধীন বাংলাদেশ সংক্রান্ত ভাবনা। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেছেন মার্জিনা মাসুদ।
মো. রুকুনুজ্জামান হিমু
শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ
২০১৬ সাল বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪৫তম বছর। ১৯৭১ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা বর্বর পাকিস্তানিদের হাত থেকে ছিনিয়ে এনেছিল স্বাধীনতা। স্বাধীনতার ৪৫ বছরে অর্জন নেহায়েতই মন্দ নয়। স্বাধীনতার পরে আমাদের দেশের অর্থনীতি অসংখ্যবার হোঁচট খেয়েছে। তবে ২০০০ সালের পরে বিদেশি বিনিয়োগ ছিল ঊর্ধ্বমুখী যা বর্তমান সরকারের আমলে আরো ত্বরান্বিত হয়েছে। প্রবৃদ্ধির হারের উন্নতিতেও বাংলাদেশ বেশ সুনাম কুঁড়িয়েছে। তবে ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত প্রবৃদ্ধির হারেও লক্ষ করা যায় ভয়াবহ ওঠানামা।
বাংলাদেশের আরেকটি বড় প্রাপ্তি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়া। বর্তমানে বাংলাদেশের মাথা পিছু আয় এক হাজার ৪৬৬ মার্কিন ডলার যা নিঃসন্দেহে এক বড় অর্জন। স্বাধীনতার ৪৫ বছরের প্রাপ্তির খাতায় আরো অনেক কিছুই যুক্ত হয়েছে যেমন, তথ্য-প্রযুক্তি খাতে উন্নতি, সেবা খাতে উন্নতি, কৃষিতে আধুনিকায়নের ছোঁয়া, গার্মেন্টস শিল্পের ব্যপক প্রসার, রেমিটেন্স ক্রমাগত উত্থান, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নোবেল অর্জন, বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাফল্য আরো কত কী! তবে আমার দৃষ্টিতে এসবকে ছাপিয়েও বাংলাদেশের আরো কিছু বড় অর্জন রয়েছে। প্রথমত, জাতিসংঘ নির্ধারিত মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল (এমডিজি) অর্জনে বাংলাদেশের সাফল্য। এ ক্ষেত্রে আটটি লক্ষ্যমাত্রার সবকটিতেই বাংলাদেশ ভালো করেছে।
উন্নত তথ্যপ্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ প্রতিটি ক্ষেত্রেই অর্জন করবে সফলতা। একজন আশাবাদী মানুষ জানে, এ দেশের তরুণরা যেমন স্বাধীনতার লাল সূর্যটাকে ছিনিয়ে এনেছিল তেমনি আজকের তরুণরাও নিয়ে আসবে নতুন এক স্বাধীনতা, যে স্বাধীনতা অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির, যে স্বাধীনতা তথ্যপ্রযুক্তির জয়গানের, যে স্বাধীনতা উন্নত বাংলাদেশের।
মো. মঈনুল হাসান খান
শিক্ষার্থী গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধের পর পাকিস্তানের কাছ থেকে অর্জিত হয়েছে আমাদের স্বপ্নের স্বাধীনতা। পৃথিবীর মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে লাল সবুজ পতাকার আশ্রয়স্থল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের। শত চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আজকের এ অর্জন। ৪৫ বছর একটি দেশের জন্য খুব বেশি সময় না হলেও কম সময় নয়। এই ভূখণ্ডকে ঘিরে আমাদের প্রত্যাশার কমতি ছিল না। দুর্নীতি, অর্থনৈতিক সংকট, দ্রব্যমূল্য ও মুদ্রাস্ফিতির আবর্তে জনজীবন আজ দুর্বিসহ ও বিপর্যস্থ হয়ে পড়েছে। যে অর্থনৈতিক মুক্তি ছিল স্বাধীনতার অন্যতম প্রত্যাশা-বিগত ৪৫ বছরে তার পূরণ হয়েছে সামান্য। আমরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি বজায় রাখতে পারি না। এখনো এ দেশের সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। সংবিধানের ৩৯ নম্বর অনুচ্ছেদে মানুষের চিন্তা-বিবেক- বাকস্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কথা উল্লেখ ধাকলেও দেশের জনগণ সে সুযোগ পাচ্ছে না।
বাংলাদেশে স্বাধীনতার ৪৫ বছরে প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির হিসাব ও তার মূল্যায়ন দুই ভাবে করা যেতে পারে। আমরা আশাবাদীদের দলে, আমরা স্বপ্ন দেখি। আমরা বিশ্বাস করি এই বাংলাদেশও একদিন পৃথিবীর বুকে মাথা উচুঁ করে দাঁড়াবে। শোষণ-নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়াবে। স্বাধীনতার ৪৫ বছরে দেশের এবং দেশের মানুষের জন্য ভালোবাসা।
মো. আল-আমিন ইসলাম
শিক্ষার্থী, পরিসংখ্যান বিভাগ
এই ৪৫ বছরে আমাদের অর্জন কম নয় । আমাদের বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ৬ ছাড়িয়েছে এবং আমরা তা ধরে রাখতেও পারছি, তৈরি পোশাকশিল্পে আমাদের অর্জন ঈর্ষণীয়, আমরা কলেরা, যক্ষ্মা প্রভৃতি রোগের ক্ষেত্রে ব্যাপক সফলতা পেয়েছি, আমাদের গবেষকরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে গবেষণায় বিশ্বব্যাপী ভূমিকা রাখছেন। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, মাতৃমৃত্যু, নবজাতক শিশুমৃত্যুর হারও আমরা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমিয়ে আনতে পেরেছি। জাতিসংঘের সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় আমাদের অর্জন বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে। অনেক অর্জনের মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তির বিভিন্ন ক্ষেত্রেও আমরা বেশ সফলতা পেয়েছি। কৃষি, চিকিৎসা, শিক্ষা, গবেষণা, বাণিজ্য প্রভৃতি নানা ক্ষেত্রে উন্নত প্রযুক্তির কার্যকর ব্যবহার ও প্রসার ঘটছে। সরকারি কাজে ইলেকট্রনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে। যদিও এখনো প্রযুক্তির ব্যবহার বেশির ভাগটাই শহরকেন্দ্রিক কিন্তু দ্রুত তা ছড়িয়ে পড়ছে প্রত্যন্ত অঞ্চলে। বাংলাদেশ নিয়ে আমি বড় স্বপ্নই দেখি ।
সোমা সরকার
শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ
স্বাধীনতার ৪৫ বছর অতিক্রম করেছে দেশ। একটি দেশের জন্য এই সময় খুব কম না হলেও অনেক বেশিও না। নানাবিধ সমস্যা মোকাবিলা করে বিগত ৪৫ বছরে আমাদের অর্জন ঈর্ষণীয়। বর্তমানে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ। এ দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি প্রযুক্তি, শিল্প, সাহিত্য, জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রভৃতি ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। সব উন্নয়নের মূলে রয়েছে আমাদের শিক্ষা ক্ষেত্রে উন্নয়ন। শিক্ষার হার বাড়ার পাশাপাশি বেড়েছে শিক্ষার মান। শিক্ষার্থীরা আজ শুধু পাঠ্যপুস্তকে সীমাবদ্ধ না থেকে করছে ইন্টারনেট ভিত্তিক জ্ঞান চর্চা। স্বাধীনতার এই ৪৫ বছরে আজ আমার প্রত্যাশা আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিতে উন্নয়নের যে জোয়ার বইছে, সেই জোয়ারে যেন আমরা হারিয়ে না ফেলি আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যকে। মেলে ধরতে চাই আমাদের বাংলাকে, বাংলাদেশকে বিশ্বের মানচিত্রে।
মাহাবুব চৌধুরী
শিক্ষার্থী উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগ
একটি দেশ এগিয়ে যাচ্ছে আর স্বাক্ষর রেখে যাচ্ছে পৃথিবী মানচিত্রে। হাজারো প্রতিকূলতা, ষড়যন্ত্র কিংবা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সাথে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে আমাদের এই পথ চলা। অর্থনীতি, রাজনীতি শিক্ষা কিংবা মানবিকতা প্রত্যাশা না পূরণ হলেও আমাদের অর্জন আমাদের আজ অনুপ্রেরণা দিচ্ছে আরো পরিশ্রম করতে, আরো এগিয়ে যেতে। আর এ অগ্রযাত্রা দেশের নারী ও পুরুষ সমানভাবে ব্যক্তি পর্যায়ে, পারিবারিক ও রাষ্ট্রিয় পর্যায়ে উন্নয়নের অংশীদার হবে। এ যাত্রা আমাদের সবার জন্য গুরুত্বপূর্ণ কেননা বাস্তবতা এখনো এমনি যে এখনো আমাদের জনগোষ্ঠীর অর্ধেক অংশ নারী তারা নিরাপদ নয়, অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়নি সর্বক্ষেত্রে, চিহ্নিত হয় পরোক্ষ বোঝা হিসেবে।
শিক্ষাক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ তুলনামূলক ভাবে বৃদ্ধি পেলেও তা মাধ্যমিক পর্যায়েই এখন সীমাবদ্ধ রয়েছে। উচ্চশিক্ষায় বিশেষ করে প্রকৌশল শিক্ষায় নারীরা এখনো উল্লেখযোগ্য হারে পিছিয়ে আছে। অনেক ক্ষেত্রেই নারীর ক্ষমতায়ন ঘটলেও, নিরাপত্তাহীনতা এখনো প্রকট। শ্রম ক্ষেত্রে মজুরি বৈষম্য, পারিবারিক পর্যায়ে নিরাপত্তা, অধিকার কিংবা জাতীয় উন্নয়নে নারীর অংশগ্রহণ অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ।