জাকসু নির্বাচনের ফল ঘোষণায় এত নাটকীয়তা কেন?

দীর্ঘ ৩৩ বছর পর অনুষ্ঠিত হয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জাকসু) ও হল সংসদ ভোট গ্রহণ। গত বৃহস্পতিবার (১১ সেপ্টেম্বর) সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ভোট দেন শিক্ষার্থীরা। এরপর প্রায় ৪৮ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও মেলেনি ফলাফলের দেখা।
সর্বশেষ প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক মো. মনিরুজ্জামান জানিয়েছেন, আজ শনিবার (১৩ সেপ্টেম্বর) বেলা ১১টা পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সংসদের ২১ কেন্দ্রের মধ্যে ১৮টি কেন্দ্রের ভোট গণনা শেষ হয়েছে। বাকি তিন কেন্দ্রের ভোট গণনা এখনও বাকি রয়েছে। দুপুর ৩টার মধ্যে গণনা শেষ হবে। পরে সন্ধ্যা ৭টায় ফল ঘোষণা করা হবে।
এর আগে, নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক লুৎফুল এলাহী বলেন, জাকসু নির্বাচনের ফলাফল শনিবার বিকেলে ঘোষণা হবে।
এরও আগে, নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা যায়, শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ক্লান্তির কারণে ভোট গণনা কিছুটা ধীরগতিতে চলছে। তবে দুপুরের আগেই যেকোনো মূল্যে ফলাফল ঘোষণা করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন তারা।
শুক্রবারও (১২ সেপ্টেম্বর) একইভাবে বারবার ফলাফলের সময় পরিবর্তন করেও শেষ পর্যন্ত ফলাফল ঘোষণা হয়নি।
জাকসুতে এবার ভোটার ছিল ১১ হাজার ৭৪৩ জন, এদের মধ্যে আট হাজারের মতো ভোট দেন। ভোটগ্রহণ শেষ হয় বৃহস্পতিবার বিকাল ৫টায়। তবে দুটি হলে শেষ সময়েও ভোটার থাকায় ৭টা পর্যন্ত ভোটগ্রহণ চলে। ভোট গণনা শুরু হয় রাত সাড়ে ৯টার দিকে। সেই থেকে এখন পর্যন্ত চলমান এই ভোট গণনা। সব মিলিয়ে নাটকীয় পরিস্থিতি বিরাজ করছে জাকসু নির্বাচন নিয়ে।
ভোটের দিনের শেষ মুহূর্তে অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলসহ পাঁচটি প্যানেল ভোট বর্জন এবং পুনর্নির্বাচনের দাবি করে। মোট আটটি প্যানেলের মধ্যে পাঁচটি প্যানেল জাকসু নির্বাচন বর্জন করলেও শেষ পর্যন্ত তিনটি বর্জন করেনি। এগুলো হচ্ছে—বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের (বাগছাস) সমর্থিত প্যানেল শিক্ষার্থী ঐক্য ফোরাম, ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেল সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট ও স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী সম্মিলন।
এদিকে নির্বাচনে নানা অনিয়মের অভিযোগ তুলে পদত্যাগের ঘোষণা দেন নির্বাচন কমিশনের সদস্য অধ্যাপক মাফরুহী সাত্তার। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান অনুষদের ভারপ্রাপ্ত ডিন এবং শিক্ষকদের সংগঠন জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরামের সাবেক সহসভাপতি। বৃহস্পতিবার নির্বাচনের কার্যক্রম থেকে পদত্যাগ করেন বিএনপপন্থী আরও তিন শিক্ষক।
এ বিষয়ে ছাত্রশিবির–সমর্থিত সমন্বিত শিক্ষার্থী জোটের সাধারণ সম্পাদক (জিএস) প্রার্থী মাজহারুল ইসলাম অভিযোগ করেন, বিএনপিপন্থী শিক্ষক অধ্যাপক নজরুল ইসলাম ও অধ্যাপক মাফরুহী সাত্তার নির্বাচন বানচালের ইন্ধন দিচ্ছেন। তারা কোনোভাবে ভোট গণনা স্থগিত চাইছেন।
দীর্ঘ সময় ধরে ভোটগণনা চলতে থাকা ও ফলাফল ঘোষণা না করতে পারায় বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে সাধারণ শিক্ষার্থী ও প্রার্থীরা। শুক্রবার রাতে ফলাফলের দাবিতে রাজধানীতেও বিক্ষোভ মিছিল হয়।
জানা গেছে, ভোটের ব্যালট স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে গণনার কথা ছিল। কিন্তু বিশ্বাসযোগ্যতার জন্য সনাতন পদ্ধতিতে চলছে গণনা। এর মধ্যে নানা ষড়যন্ত্রের ডালপালা ছড়াচ্ছে একটি মহল। কেউ কেউ বলছেন, উপাচার্য পদ বাগিয়ে নিতে দলবাজ শিক্ষকদের একটি অংশ ভোটগণনা ঠেকানোর মাধ্যমে ফল প্রকাশ আটকাতে চান। আবার ভোটগ্রহণে জড়িতরা বলছেন, ভোটের দিন রাত ১১টার মধ্যে ফল প্রকাশ করা গেলে কোনো শিক্ষক জান্নাতুল ফেরদৌসকে প্রাণ দিতে হতো না।

জাকসু নির্বাচনের ভোটগ্রহণের শেষ সময় বিকাল ৫টা পর্যন্ত হলেও বেশ কয়েকটি কেন্দ্রে ভোটারের দীর্ঘ সারির কারণে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া কেন্দ্রগুলোতে ভোটগণনা না করে কেন্দ্রীয়ভাবে নির্বাচন কমিশনের কার্যালয়ে সব ব্যালট বাক্স জড়ো করে গণনার কারণে বেশ সময়ক্ষেপণ হয়।
ভোট গণনার চার ঘণ্টারও বেশি সময় পর রাত সাড়ে ৯টায় গণনা শুরু হয়। এছাড়া রিটার্নিং কর্মকর্তা ও পোলিং অফিসারদের নিজ কেন্দ্রের ভোট গণনার দায়িত্ব না দিয়ে সম্মিলিতভাবে ভোট গণনার কারণে কিছু লোক গণনার কাজে ব্যস্ত থাকলেও বড় একটি অংশকে বসে থাকতে হয়েছে। এতে করে অহেতুক সময় নষ্ট হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেন।
জাকসু নির্বাচনের আগের দিন দুপুর পর্যন্ত স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে ভোট গণনা হওয়ার কথা থাকলেও রাতেই পাল্টে যায় সিদ্ধান্ত। একাধিক প্যানেলের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সনাতন পদ্ধতিতে ভোটগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয় কমিশন। এতে প্রভাব পড়ে পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়ায়। এছাড়া শুক্রবার সকালে এক পোলিং অফিসারের মৃত্যুর ঘটনায় নির্বাচন স্থগিত হতে পারে বলে গুঞ্জন ওঠে।
এ খবরে নির্বাচন কমিশনে ছুটে আসেন ভোটার ও প্রার্থীরা। জরুরি বৈঠকের ডাক দেন উপাচার্য। শুক্রবার রাতের মধ্যেই ফল প্রকাশ না হওয়ার শঙ্কায় কমিশনের সামনে অবস্থান কর্মসূচি ঘোষণা করে ছাত্রশিবির সমর্থিত সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট ও স্বতন্ত্র পরিষদ। নির্বাচন কমিশনে বাড়ানো হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য। প্রার্থী ও ভোটারদের চাপের মুখে নতুন করে পাঁচটি ভোট গণনার টেবিল বাড়ানো হয়।
উল্লেখ্য, গত বৃহস্পতিবার (১১ সেপ্টেম্বর) সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত জাকসু ও হল সংসদের ভোটগ্রহণ করা হয়।

এবার জাকসুর মোট ভোটার ১১ হাজার ৭৪৩ জন। এর মধ্যে ছাত্রী ৫ হাজার ৭২৮ এবং ছাত্র ৬ হাজার ১৫ জন। কেন্দ্রীয় সংসদে মোট ২৫টি পদে লড়ছেন ১৭৭ জন প্রার্থী।
সহসভাপতি (ভিপি) পদে প্রার্থী ৯ জন। সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে ৮ জন। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (নারী) পদে ৬ জন এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (পুরুষ) পদে ১০ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

একেকটি হলে পদসংখ্যা ১৫। ২১টি হল সংসদে মোট পদ ৩১৫টি। এতে ৪৭৭ জন প্রার্থী হয়েছেন। ছাত্রীদের ১০টি আবাসিক হলে ১৫০টি পদের মধ্যে ৫৯টিতে কোনো প্রার্থী নেই। একজন করে প্রার্থী রয়েছে ৬৭টি পদে। সে হিসেবে মাত্র ২৪টি পদে ভোট হয়েছে।