ব্যাংকে নেই নতুন নোট, বাইরে দ্বিগুণ দরে ব্যবসা

ঈদে নতুন টাকার নোট পাওয়ার লোভ শিশু থেকে বৃদ্ধের সবারই থাকে। তাদের ঈদের আনন্দকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয় নতুন টাকার কচকচে নোট। সেই লক্ষে সরকার ঈদের আগেই বিনিময় করছে ১০০০, ৫০ ও ২০ টাকার নতুন ডিজাইনের নোট। তবে, দুঃখের ব্যাপার হলো, সেই নতুন ডিজাইনের টাকার নোট আসা মাত্র মিলছে না ব্যাংকে। অনেকটা উধাও হয়ে চলে যাচ্ছে ব্যাংকের বাইরে।
মানুষের ঈদের খুশির আবেগকে পুঁজি করে একটি চক্র কয়েকবার হাতবদল করে নতুন টাকার নোট নিয়ে ব্যবসায় মেতেছে খোলাবাজারে। সেখানে টাকার নতুন নোট পেতে গ্রাহককে গুনতে হচ্ছে দ্বিগুণ অর্থ। ঢাকার গুলিস্তান ও মতিঝিলে আইনকে পাশ কাটিয়ে প্রকাশ্যে বেচাকেনা করছে ২০, ৫০ ও ১০০০ টাকার নতুন ডিজাইনের নোট।
সরেজমিনে দেখা যায়, গুলিস্তানে ২০ টাকার নতুন নোটের একটি বান্ডিল (১০০টি) বেচা হচ্ছে চার হাজার টাকা। অর্থাৎ ২০ টাকার নতুন ১০০টি কচকচে নতুন নোট পেতে ক্রেতাকে গুনতে হচ্ছে দুই হাজার টাকা বেশি। ৫০ টাকার নতুন ১০০টি নোট পেতে ক্রেতাকে গুনতে হচ্ছে আট হাজার টাকা। অর্থাৎ ৫০ টাকার নতুন ১০০টি কচকচে নোট পেতে ক্রেতাকে গুনতে হচ্ছে তিন হাজার টাকা বেশি। অপরদিক ১০০০ টাকার নতুন ১০০টি নোট পেতে ক্রেতাকে গুনতে হচ্ছে এক লাখ ছয় হাজার টাকা। অর্থাৎ ১০০০ টাকার নতুন ১০০টি কচকচে নোট পেতে ক্রেতাকে গুনতে হচ্ছে ছয় হাজার টাকা বেশি।
অবশ্য মতিঝিলে কিছুটা কমে মিলছে নতুন টাকার নোট। সেখানে (মতিঝিলে) ২০ টাকার নতুন নোটের একটি বান্ডিল বেচা হচ্ছে তিন হাজার টাকা। অর্থাৎ ২০ টাকার নতুন ১০০টি কচকচে নোট পেতে ক্রেতাকে গুনতে হচ্ছে এক হাজার টাকা বেশি। ৫০ টাকার নতুন ১০০টি নোট পেতে ক্রেতাকে গুনতে হচ্ছে সাত হাজার টাকা। অর্থাৎ ৫০ টাকার নতুন ১০০টি কচকচে নোট পেতে ক্রেতাকে গুনতে হচ্ছে দুই হাজার টাকা বেশি। অপরদিকে ১০০০ টাকার নতুন ১০০টি নোট পেতে ক্রেতাকে গুনতে হচ্ছে এক লাখ পাঁচ হাজার টাকা। অর্থাৎ ১০০০ টাকার নতুন ১০০টি কচকচে নোট পেতে ক্রেতাকে গুনতে হচ্ছে পাঁচ হাজার টাকা বেশি।
গত ঈদে নতুন টাকার নোট না দিলেও এবার দিবে, এমন ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক, তাও দেওয়া হবে নতুন ডিজাইনের নোট। এ প্রসঙ্গে ব্যাংকটির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর স্বাক্ষরিত নতুন ডিজাইন ও সিরিজের ২০, ৫০ ও ১০০০ টাকা নতুন নোট ইতোমধ্যে বাজারে সরবরাহ করেছি। প্রায় ২০০ কোটি টাকা পরিমানের নতুন নোট গ্রাহকরা বেঁধে দেওয়া নির্দিষ্ট ব্যাংকগুলো থেকে সংগ্রহ করছে। তিনি বলেন, গত সোমবার থেকেই ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের কাছে নতুন টাকার নোট বিনিময় করছে। খোলাবাজারে টাকা বেচাকেনা প্রসঙ্গে আরিফ হোসেন খান বলেন, টাকার বেশি দামে কেনাবেচা আইন অনুযায়ী দণ্ডনীয় অপরাধ।
গত সোমবার থেকে ১০০০, ৫০ ও ২০ টাকার নতুন নোট সীমিত পরিসরে বিনিময় করছে দেশের ১১টি বাণিজ্যিক ব্যাংক। নতুন টাকা বিনিময় হচ্ছে এমন ব্যাংকগুলো হলো- সোনালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, উত্তরা ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, ডাচ-বাংলা ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক, আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক এবং ইস্টার্ন ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেওয়া ব্যাংকে পাওয়া যাচ্ছে না নতুন টাকার নোট- এমন অভিযোগ করে ব্যাংকগুলোর গ্রাহকরা বলেন, ২০ ও ৫০ টাকার নতুন নোট পাচ্ছি না ব্যাংকে। চাইলেও বলছে, ছোট নোট লেনদেন করি না। লেনদেনে সমস্যা হয়। সেখানে মিলছে কেবল ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট। তাও পুরানো ও ছেঁড়া। তবে খোলাবাজারে পাওয়া যাচ্ছে নতুন টাকার নোট। এই নোটগুলো আসলো কোথা থেকে- এমন প্রশ্ন গ্রাহকদের।
টাকার বেশি দামে কেনাবেচা আইন অনুযায়ী দণ্ডনীয় অপরাধ। আমাদের দেশে টাকা ইস্যু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই টাকা বাজারে নির্ধারিত মূল্যে ছাড়ার জন্য বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকে সরবরাহ করে। ব্যাংক থেকে নির্ধারিত মূল্যের বেশি দামে টাকা বেচাকেনা আইনগতভাবে নিষিদ্ধ। বাংলাদেশের মুদ্রা আইন এবং বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক প্রদত্ত নিয়মাবলীর আওতায় টাকা সংগ্রহের ক্ষেত্রে যেকোনো অনৈতিক বা অবৈধ লেনদেন শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়। এই অপরাধের জন্য অর্থদণ্ড বা কারাদণ্ড হতে পার।
সোনালী, জনতাসহ পাঁচ বাণিজ্যিক ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলেন, এখন প্রায় সব ব্যাংক ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট লেনদেন করে থাকে। হিসেবের সুবিধায় ২০০, ১০০, ৫০, ২০, ১০ ও পাঁচ টাকার নোট লেনদেন থেকে বিরত থাকে। তবে ঈদের জন্য গ্রাহকদের চাহিদা মেটাতে অনেক কিছুই করতে হচ্ছে আমাদের। এটাও সত্যি যে, অনেকদিন ধরেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন টাকার নোট দেয়নি। তবে এবার ২০, ৫০ ও ১০০০ টাকার নতুন নোট দিয়েছে। যেটা লেনদেনের প্রথমদিন দুই-তিন ঘন্টার মধ্যে নতুন নোট বিনিময় করা শেষ হয়েছে। এবারে যে পরিমাণ নতুন নোট পাওয়া গেছে, তা গ্রাহকদের চাহিদার পাঁচ শতাংশও পূরণ হয়নি।
গুলিস্তান থেকে ২০ হাজার টাকা দিয়ে তিনটি বাল্ডিলের নতুন নোট কিনলেন ব্যবসায়ী নুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, আমি সোনালী ব্যাংকের গ্রাহক। আজ সকালে গিয়েছি কিন্তু ব্যাংকে নতুন টাকার নোট নেই। ব্যাংক কর্মকর্তা বলছেন, নতুন টাকার নোট দেওয়া শেষ। তাদের কাছে নতুন নোট আর নেই। ব্যাংকে না পেয়ে গুলিস্তানে এসেছি। এখানে এসে দেখি, নতুন নোটের রমরমা ব্যবসা।
নতুন নোট পেলে সবাই মুখেই ঈদের আমেজ দেখা মিলে জানিয়ে তিনি বলেন, সেই চিন্তা করেই অতিরিক্ত দামে দিয়ে নতুন টাকার নোট কেনা। ছয় হাজার টাকা বেশি দিয়ে ৫০ টাকার নোটের নতুন দুইটি বান্ডিল কিনতে হয়েছে। ২০ টাকার নতুন নোটের একটি বান্ডিল কিনতে হয়েছে দুই হাজার টাকা বেশি দিয়ে। মানে ২০ টাকার নতুন বান্ডিল নোট কিনতে হয়েছে ডাবল দাম দিয়ে, এমন দিন আসবে চিন্তা করিনি।
কথা হয় নতুন টাকা কিনতে আসা বেসরকারি চাকুরীজীবি আবিদ আরমানের সঙ্গে। ব্যাংকে নতুন নোট না পেয়ে আক্ষেপ নিয়ে তিনি বলেন, শিশুদের ঈদ আনন্দ কয়েকগুণ বাড়িয়ে নতুন টাকার কচকচে নোট। তাই নতুন নোট কিনতে মতিঝিলে আসা। কিন্তু এখানে এসে দেখছি নতুন নোটের দামে আগুন লেগেছে। এতো বেশি দাম চাচ্ছে, কিনতে সাহস মিলছে না। কিন্তু কিনতে হবে, কারণ বাচ্চারা নতুন টাকার নোট পেলে খুব খুশি হয়। তাই তাদের খুশি মানেই আমরা খুশি।
নতুন টাকা কিনতে আসা আরেক ক্রেতা আইরিন জামিলের সঙ্গে কথা হয় মতিঝিলে। তিনি বলেন, দুই হাজার টাকা বেশি দিয়ে ৫০ টাকার নোটের একটি বান্ডিল কিনতে হয়েছে। ২০ টাকার নতুন নোটের একটি বান্ডিল কিনতে হয়েছে এক হাজার টাকা বেশি দিয়ে।
এতো দামে কেন নতুন নোট বিক্রি করছেন এমন প্রশ্নে মতিঝিলের ও গুলিস্তানের একাধিক অবৈধ টাকা ব্যবসায়ী বলেন, বাজারের নতুন ডিজাইনের নোটের কদর অনেক বেশি। এজন্য দামও বেশি। বিভিন্ন হাত হয়ে ব্যাংক থেকে তাদের কাছে নতুন টাকার নোট আসে জানিয়ে তারা বলেন, অনেক বেশি অর্থ দিয়ে স্যারদের কাছ থেকে নতুন নোট কিনতে হয়েছে। প্রতি বান্ডিলে আমাদের ৭০০ থেকে এক হাজার টাকা বেশি অর্থ গুনতে হয়েছে। কোনো বান্ডিলে এর চেয়েও বেশি গুনতে হয়েছে। বাজার ভাল তাই প্রতি বান্ডিলে বেশ লাভও পাচ্ছি। বাজারমানে দামে ভিন্নতা রয়েছে।
গুলিস্তানের টাকা বিক্রেতা হোসেন বলেন, ২০ টাকার বান্ডিলের নতুন নোট আমাদের হাজার টাকা বেশি দিয়ে কিনতে হচ্ছে। ৫০ টাকার বান্ডিলের নতুন নোট দেড়-দুই হাজার টাকা বেশি দিয়ে কিনতে হচ্ছে। সেখান থেকে সামান্য লাভ পেয়ে বিক্রি করছি।
কিভাবে নতুন নোট এখানে আসছে, কারা বিক্রি করছে এসব প্রসঙ্গে মতিঝিলে এক নারী ব্যবসায়ী বলেন, ‘এতো বলা যাবে না। স্যাররা আমাদের দিয়ে যায়, আমার অতিরিক্ত দাম দিয়ে কিনছি। সামনে টাকা আরও বেশি দামে কিনতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, বাজারের নতুন নোটের চাহিদা অনেক। আনা মাত্র বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। চাহিদা বাড়লে সামনে ২০ ও ৫০ টাকার নোট আরও বেশি দামে কিনতে হবে।’