খালেদা জিয়ার স্মরণীয় প্রত্যাবর্তন

প্রিয় মাতৃভূমিতে এ এক অন্য রকম ফেরা। নিকট অতীতে নির্যাতন, বন্দিদশা আর নিপীড়নের খড়গে নিষ্পেষিত ‘আপসহীন’ এক নেত্রীর জনতার ভালোবাসা নিয়ে ফিরে আসা। বদলে যাওয়া সময়ে অনাগত রাজনীতির পালে নতুন পথচলায় ঐক্যের আশা হয়ে যেন ফিরলেন তিনি। তাই তো নেত্রীকে বরণে পথে পথে লাখো মানুষের ফুলেল শুভেচ্ছা বার্তা।
দেশ ও জাতির এক সংকটময় মুহূর্তে গৃহবধূ খালেদা জিয়া রাজনীতির চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে হয়ে উঠেন সফল রাজনীতিবিদ। এরপর জনতার রায় তাঁকে প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসায়। মামলা, নির্যাতন আর জেল জীবনের নিদারুণ কষ্টও তাঁকে কখনই বিচলিত করেনি। স্বামী শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আদর্শকে পাথেয় করে মা, মাটি ও মানুষের রাজনীতি বিকশিত করার সংগ্রামে অদম্য অবিচলতা তাঁকে দিয়েছে আপসহীন নেত্রীর উপাধি।
প্রায় চার মাস আগে উন্নত চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যান বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। আজ মঙ্গলবার (৬ মে) সকাল সাড়ে ১০টার পর তাঁকে বহনকারী ‘বিশেষ বিমান’ হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। এরপর বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে ফুল দিয়ে তাঁকে অভ্যর্থনা জানানো হয়।

এরপর মির্জা ফখরুল সাংবাদিকদের বলেন, ‘গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরী, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ফ্যাসিস্টদের হাতে নির্যাতিত হয়ে, কারাবন্দি থাকার পর, দেশ ফ্যাসিবাদ মুক্ত হওয়ার পর যুক্তরাজ্যে চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলেন। সেখানে প্রায় চার মাস চিকিৎসার শেষে তিনি আজ দেশে ফিরে এলেন। এটা আমাদের জন্য, গোটা জাতির জন্য অত্যন্ত আনন্দের দিন। আমরা মনে করি, তাঁর এই উপস্থিতি, দেশে ফিরে আসা—এটা আমাদের গণতন্ত্রে উত্তরণের পথকে আরও সহজ করবে। দেশকে একটা সঠিক, বৈষম্যহীন পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যেতে সহযোগিতা করবে।’
বিমানবন্দর থেকে গুলশানের বাসভবন ফিরোজার উদ্দেশে রওনা হয় বেগম জিয়ার গাড়িবহর। নিজ বাসায় ফিরেন দলের নেতাকর্মী আর লাখো মানুষের ভালোবাসা ও ফুলেল শুভেচ্ছায় সিক্ত হয়ে।

এ সময় বিমানবন্দর থেকে শুরু করে পুরো সড়ক নিরাপত্তা চাদরের ঢাকা ছিল। সেনাবাহিনী, র্যাব, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খবাহিনীর সতর্ক অবস্থানের মধ্য দিয়ে নেতাকর্মী ও লাখো জনতার ভিড় ঠেলে দুপুর ১টা ২৫ মিনিটে বাসায় প্রবেশ করেন খালেদা জিয়া। গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে বাসভবনের দ্বিতীয় তলায় উঠেন তিনি। সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর এমন রাজসিক দেশে ফেরা ইতিহাসে স্মরণীয় প্রত্যাবর্তন হিসেবে উল্লেখ করেছেন অনেকেই।
খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেশে ফিরেছেন দুই পুত্রবধূ ডা. জুবাইদা রহমান ও শর্মিলা রহমানও। বাসায় পৌঁছে নেতাকর্মী ও দেশবাসীকে শুভেচ্ছা ও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন বেগম জিয়া। তাঁর দেশে ফিরে আসা গণতন্ত্র উত্তোরণের পথকে সহজ করবে বলে মনে করছেন দলটির নেতারা।

আজকের এই খালেদা জিয়া হয়ে উঠার গল্পটা বেশ লম্বা। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বীর উত্তমের মৃত্যুতে দুই শিশু সন্তান নিয়ে একা হয়ে পড়েন নিপাট এক গৃহবধূ খালেদা খানম পুতুল। অভিভাবককে হারিয়ে কেবল বিয়োগের বেদনাই নয়, অনাগত পথচলার অনিশ্চয়তাও ভর করে তাঁর সংসারে।
স্বামীর মৃত্যুর পর নেতাকর্মীদের আহ্বানে ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি বিএনপির প্রাথমিক সদস্য হওয়ার মাধ্যমে রাজনীতিতে অভিষেক ঘটে গৃহবধূ পুতুলের। ’৮৩ সালে হন বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান আর বিচারপতি সাত্তার অসুস্থ হলে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন হন তিনি। ’৮৪ সালের ১০ মে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন চেয়ারপারসন।
এরশাদের স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে ’৮৩ সালে খালেদা জিয়ার দৃঢ় নেতৃত্বে গঠিত হয় সাতদলীয় ঐক্যজোট। ’৮৬ সালের নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল থাকায় তাঁকে কর্মীরা দেন আপসহীন নেত্রীর খেতাব। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারের পতনের যুগপৎ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন তিনি। এরপর ১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৪০ আসন পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হন তিনি।
১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দ্বিতীয়বার এবং ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনতার রায় বেগম জিয়াকে তৃতীয়বারের মতো আসীন করে প্রধানমন্ত্রীর আসনে।
২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত ফখরুদ্দীন সরকারের সময়ে কারাবন্দি করা হয় বিএনপিনেত্রীকে। চলে দল ভাঙ্গার ষড়যন্ত্রও। ২০০৮ সালে নবম সংসদ নির্বাচনে দ্বিতীয়বার বিরোধীদলীয় নেত্রীর আসনে বসেন খালেদা জিয়া। ২০১১ সালের ৩০ জুন জাতীয় সংসদে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে আওয়ামী লীগ সরকার। এরপর নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে মাঠে নামেন তিনি। বর্জন করেন ২০১৪ সালের নির্বাচন। দাবি আদায়ের আন্দোলন করতে গিয়ে গুলশানে নিজ বাসভবন ‘ফিরোজা’ ও দলীয় কার্যালয়ে অবরুদ্ধ হন এই নেত্রী। তাঁকে বের করে দেওয়া হয় মইনুল রোডের বাড়ি থেকেও। ফ্যাসিবাদী সরকারের প্রতিহিংসা মোকাবিলায় পড়তে হয় প্রায় অর্ধশতাধিক মামলায়। দণ্ডাদেশ দিয়ে তাঁকে বন্দি করা হয় নিঃসঙ্গ ও স্যাঁতস্যাঁতে কারাগারে।
ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর অকাল মৃত্যু আর তারেক রহমানের নির্বাসনে পরিবার-পরিজনহীন আপসহীন নেত্রীকে করে তোলে একলা জীবনের বাসিন্দা। এতে দিন দিন তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। জটিল সব রোগ বাসা বাঁধে শরীরে।

গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিবাদী শাসনের পতনের পর বদলে যাওয়া নতুন বাংলাদেশে আবারও বেগম জিয়ার কণ্ঠস্বর উদ্বেলিত করে দেশজুড়ে থাকা নেতাকর্মী আর সাধারণ মানুষের হৃদয়। গত ৮ জানুয়ারি লন্ডনে যান তিনি। বড় ছেলে তারেক রহমানের সান্নিধ্য আর উন্নত চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরে তিনি আবারও রাজনীতিতে প্রত্যাশার আলোঘর হবেন বলেই বুক বেঁধে আছেন দেশজুড়ে থাকা নেতাকর্মীরা।
বিএনপির চেয়ারপারসন দেশে ফেরার পর তাঁর সাবেক প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান সোহেল নিজের ফেসবুকে এক পোস্টে লিখেছেন, ‘তৃতীয় বিশ্বের কোনো রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীর পক্ষে এর চেয়ে উঁচুতে উঠা সম্ভব নয়। তিনি জাতীয় ঐক্য, মর্যাদা ও নিরাপত্তার প্রতীকে পরিণত হয়েছেন। দলের বা সরকারের নেতৃত্বের ঊর্ধে উঠে গেছেন তিনি। এর মাধ্যমে বাংলাদেশে রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটল। একটি রাজনৈতিক দলের তৃতীয় অধ্যায়ের সূত্রপাত ঘটল। আমার ভেতরে আজ আনন্দ ও বেদনার মিলিত অনুভূতি।’
খালেদা জিয়ার আগমন উপলক্ষে সকাল থেকে গুলশানের বাসভবন ফিরোজাসংলগ্ন এলাকায় ভিড় করে দলীয় নেতাকর্মীরা। তাদের হাতে ছিল জাতীয় পতাকা ও দলীয় পতাকা। এ ছাড়া তারা নানা ব্যানার-ফেস্টুন বহন করে। তারা স্লোগানে স্লোগানে মুখর করে তোলে পুরো এলাকা।
ফিরোজা ও এর আশপাশের এলাকায় আগেই নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। ফিরোজার প্রবেশপথ গুলশান-২ নম্বরের ৭৯ নম্বর সড়কের সামনে ব্যারিকেড দেওয়া হয়। সড়কটির দুই পাশে কড়া নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয়।
কাতারের আমিরের দেওয়া রয়েল এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে বেগম খালেদা জিয়া যখন প্রিয় মাতৃভূমির মাটি স্পর্শ করেন তখন পথে পথে মানুষের ঢল। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলের সিনিয়র নেতারা বেগম জিয়াকে বিমানবন্দরে উষ্ণ অভিবাদন জানান। পরে তাঁর গাড়িবহর মানুষের শুভেচ্ছায় সিক্ত হতে হতে এগিয়ে চলে গুলশান অভিমুখে। বিমানবন্দর থেকে কুড়িল বিশ্ব রোড হয়ে বনানী গুলশানের পথজুড়ে অবস্থান করা নেতাকর্মী আর সাধারণ মানুষ ভালোবাসা জানায় জাতীয়তাবাদী আদর্শের এই নেত্রীকে।
গেল এক দশকেরও বেশি সময় গুলশান দুই নম্বর সড়কের যে বাড়িকে করে রাখা হয়েছিল নিঃসঙ্গ ও নির্জন, সেখানে এখন তুমুল উচ্ছ্বাস আর উদ্দীপনার বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস।
ফিরোজা আবারও ফিরেছে পুরোনো রূপে, যে ফিরোজায় নিকট অতীতে গৃহবন্দি আর পরিবারহীন একাকী সময় কেটেছিল তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়ার, সেখানে তিনি এবার ফিরলেন দুই পুত্রবধূ ও অগনিত মানুষের ভালোবাসা নিয়ে। বেগম জিয়ার গাড়ি বহরকে স্বাগত জানাতে তখন সরগরম ফিরোজা। নেতাকর্মী আর সাধারণ মানুষের ভিড়ে জাতীয়তাবাদের নেত্রী ফিরলেন তাঁর আপন নীড়ে।
খালেদা জিয়া গুলশানের বাসায় ফেরার পর বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দলের নেতাকর্মীদের ফিরে যাওয়ার এবং বাসার সামনে ভিড় না করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘তিনি (খালেদা জিয়া) এখন কিছুটা অসুস্থ। চিকিৎসকরা তাঁকে কমপক্ষে আট ঘণ্টা সম্পূর্ণ বিশ্রামে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। তাই কেউ এখানে স্লোগান দেবেন না, ভিড় করবেন না। দয়া করে আপনারা সবাই এখন যার যার বাড়িতে ফিরে যান।’

বিএনপির মহাসচিব আরও বলেন, ‘দলের পক্ষ থেকে বারবার অনুরোধ করছি, যেন এখানে কোনো গণ্ডগোল না হয়। পরে সময় হলে আপনাদের সঙ্গে তিনি কথা বলবেন।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও বেগম জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন বলেন, লন্ডনে চিকিৎসা নেওয়ার পর বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে। চিকিৎসার পর উনি অনেকটুকু সুস্থ আছেন এবং মানসিকভাবেও উনি স্ট্যাবল (শক্ত) আছেন। আপনারা ওনার জন্য দোয়া করবেন।
খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা নিয়ে ডা. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘তিনি শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ আছেন। যদিও দীর্ঘ ১৪ ঘণ্টার ভ্রমণের কারণে তিনি কিছুটা অবসন্ন। আমরা তাঁর জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চাই।’
বিএনপির চেয়ারপারসন সবাইকে শুভেচ্ছা, সালাম ও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন বলে জানান ডা. জাহিদ হোসেন। খালেদা জিয়ার জন্য কাতারের পক্ষ থেকে বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুলেন্স দেওয়ায় দেশটির সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, কাতার সরকার সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে এটি দিয়েছে। এ সহায়তার মধ্য দিয়ে জিয়া পরিবারের সঙ্গে তাদের যে সম্পর্ক, তার পুনঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে দেশটি।