মজুরি দেরিতে হলে ক্ষতিপূরণ ও নিহত শ্রমিকদের শহীদ স্বীকৃতির সুপারিশ

শ্রমিকদের নিরাপদ কর্মপরিবেশ ও সঠিক সময়ে ন্যায্য মজুরি নিশ্চিতকরণের জন্য একাধিক সুপারিশ করেছে শ্রম সংস্কার কমিশন। আজ সোমবার (২১ এপ্রিল) কমিশনের প্রধান সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদ কমিশনের প্রতিবেদনের বিষয়ে এক ব্রিফিংয়ে এই তথ্য জানান।
সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদ বলেন, বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষা এবং মর্যাদাপূর্ণ জীবন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গঠিত শ্রম সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দিয়েছে।
শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রধান বলেন, প্রতিবেদনে জাতীয় শ্রম কমিশন গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে। কমিশনের পক্ষ থেকে শ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তা, ন্যায্য মজুরি এবং নিরাপদ কর্মপরিবেশের নিশ্চয়তা প্রদানের কথা বলা হয়েছে। সাড়ে সাত কোটি শ্রমিকের জন্য মজুরি কমিশন গঠনের সুপারিশের পাশাপাশি নারী শ্রমিকদের জন্য ছয় মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটির প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া প্রতিবেদনে সকল ক্ষেত্রে ‘মহিলা’ শব্দের পরিবর্তে ‘নারী’ শব্দ ব্যবহারের সুপারিশ করা হয়েছে।
শ্রমজীবী মানুষের ত্যাগকে স্মরণ করে তাদের জন্য একটি স্মৃতি জাদুঘর প্রতিষ্ঠার সুপারিশও করা হয়েছে বলে জানান কমিশনের প্রধান।
সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদ আরও বলেন, বাংলাদেশের শ্রম আইন এমনভাবে ঢেলে সাজানো উচিত, যেখানে শ্রমিকদের ন্যূনতম স্বীকৃতি নিশ্চিত করা হবে এবং একদিনের কর্মসংস্থানের জন্যও নিয়োগপত্র প্রদানের বিধান রাখা হবে। আইনকে সার্বজনীন হতে হবে এবং এর বাস্তবায়ন কাঠামোও সর্বজনীন হতে হবে। কর্মপরিবেশ উন্নত করার লক্ষ্যে প্রতিবেদনে জাতীয় সামাজিক সংলাপ কোরাম গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে।
শ্রমিকদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য শ্রম আদালতের সংখ্যা বৃদ্ধি ও মজুরি দেরিতে পরিশোধের ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ প্রদানের কথাও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে বলে জানিয়ে কমিশনের প্রধান বলেন, নিবন্ধিত সকল অভিবাসী শ্রমিককে শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের সুপারিশ করা হয়েছে। রানা প্লাজার দুর্ঘটনার অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার ওপরও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেদনে শ্রম সংস্কার কমিশন ২৫টি মূল সুপারিশের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান ও শ্রমিক আন্দোলনে নিহত সকল শ্রমিককে রাষ্ট্র কর্তৃক শহীদের স্বীকৃতি প্রদান, কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা বা অবহেলায় নিহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ ও আহতদের পুনর্বাসন এবং চিকিৎসার জন্য রাষ্ট্রীয় নীতি গ্রহণ, রানা প্লাজা, তাজরিন গার্মেন্টস ও হাসেম ফুডসহ গুরুত্বপূর্ণ কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনার জন্য দায়ীদের দ্রুত বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করা।
সুপারিশে সব শ্রমিকের আইনি সুরক্ষা ও স্বীকৃতির কথা বলা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক, অপ্রাতিষ্ঠানিক, কৃষি, গৃহভিত্তিক, অভিবাসী, স্বনিয়োজিত শ্রমিকসহ সব শ্রমিকের জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক শ্রম আইনের সুরক্ষা নিশ্চিত করার সুপারিশ করা হয়েছে। এই লক্ষ্যে কাজের স্বীকৃতি ও পরিচয়পত্র নিরবচ্ছিন্ন কাজ এবং আয়ের নিশ্চয়তা, মর্যাদাকর-শোভন কর্ম পরিবেশ, অস্থায়ী ও এজেন্সি নির্ভর নিয়োগের ক্রমবর্ধমান প্রবণতা রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ।
সুপারিশে নিজের ও পরিবারের মর্যাদাকর জীবনযাপন উপযোগী ন্যায্য মজুরি (লিভিং ওয়েজ), উন্নয়নে ন্যায্য অংশীদারত্ব ও হিস্যা-প্রাপ্তির অধিকার, প্রত্যেকের জন্য নিরাপদ কাজ ও স্বাস্থ্যসম্মত কর্মপরিবেশ, দুর্ঘটনায় যথাযথ ক্ষতিপূরণ এবং নিজের ও পরিবারের সাধারণ স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার অধিকার, প্রত্যেকেরই অবসর, কর্ম অক্ষমতা, অসুস্থতা, মাতৃত্বকালীন সময় বা যেকোনও প্রতিকূল অবস্থায় সামাজিক নিরাপত্তা প্রাপ্তি এবং কোনও না কোনও সামাজিক নিরাপত্তা স্কিমে অন্তর্ভুক্তি, প্রত্যেকের অধিকার সুরক্ষা ও ন্যায্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করার জন্য সংগঠিত হওয়া, সমষ্টিগতভাবে প্রতিনিধিত্ব করার, অধিকার লঙ্ঘনে অভিযোগ জানানো, প্রতিকার ও ন্যায়বিচার পাওয়ার নিশ্চয়তার কথা বলা হয়েছে।
এই অধিকারগুলো নিশ্চিত করার জন্য সরকার কর্তৃক দেশের সংবিধান, আইএলও কনভেনশন ও কর্মক্ষেত্রে মৌলিক নীতিমালা এবং অধিকার সংক্রান্ত ঘোষণা, শোভন কাজের মানদণ্ড এবং মানবাধিকার ও ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক দায়বদ্ধতার আলোকে যথাযথ ত্রিপক্ষীয় পদ্ধতি অনুসরণ করে বর্তমান শ্রম আইনের প্রয়োজনীয় সংস্কার বা একাধিক আইন প্রণয়ন এবং কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে।